তানভির অনয়
কলেজ জীবন শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিলাম মাথার চুল আমি আর কাটাচ্ছি না। ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজে পড়েছি তাই চুল বড় করার কোন সুযোগও ছিল না। চুল অল্প খানেক বড় হতে শুরু করলেই সঙ্গে সঙ্গে স্যার-ম্যাডামদের চোখে পড়ে যেতো। আর না কেটে যাওয়ার সাহসও করতে পারতাম না। চুল বড় করার ব্যাপারে আমি বাসায় কাউকে কিছুই জানাইনি। হয়তো মনে করেছিলাম আমার চুল আমার সম্পদ। আমি বড় করি বা ছোট করি বা নাই বা রাখি সেটা সমাজ তো দূরের কথা, অন্তত আমার পরিবার আমায় কিছু বলবে না। প্রশ্ন করবে না। আমার ভুল ভাঙ্গতে তেমন একটা সময় লাগলো না।
চুল বড় করার প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল। যেহেতু পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না সেহেতু পুরো বিষয়টি আমার জানাশোনার বাইরে ছিল। চুল গজাতে লাগলো তার আপন মনে, ওদিকে আমার চারপাশের মানুষের ভুরূ উঠতে লাগলো টগবগিয়ে। বিশেষ করে আমার পরিবারের মানুষ প্রতিদিন আমার চুল কাটানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। চুল যখন প্রায় কাঁধ ছুঁই ছুঁই তখন যেন শুধু আমার পরিবার নয়, আমার বন্ধুবান্ধব, এমনি চারপাশের মানুষ হাপিত্যেশ শুরু করলো। কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব বাদে বাদবাকি সবাই মেয়েলী, অসভ্য এবং বিচ্ছিরী রকমের তকমা দিতে লাগলো। আমি দেখতে লাগলাম, শুনতে লাগলাম এবং বুঝতে লাগলাম।
তবে এই প্রক্রিয়াটা বেশীদিন কাজে লাগলো না। ধীরে ধীরে সবকিছু ভাঙ্গতে শুরু করলো।
লম্বা চুল সমাজের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ওভাবে ভেবে দেখিনি। রাস্তাঘাট দিয়ে চলার পথে প্রত্যেক মানুষ চোখ বড় বড় করে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন আমি কোন ভিনগ্রহের প্রাণী। যার কোন জায়গায় নিয়ে এই সাধারণ সমাজে। তারা হাসে, তাদের বন্ধুদের ডেকে নিয়ে দেখায়। যেন চিড়িয়াখানা থেকে আজব চিড়িয়া হঠাৎ লোকালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিড়বিড় করে কটূক্তি করে, আমি পড়তে পারি। বেশীরভাগ মানুষের অঙ্গভঙ্গি দেখে আন্দাজ করতে পারি কি চলছে তাদের মধ্যে। ছোট ছেলেমেয়েরা হা করে তাকিয়ে গা দুলিয়ে হাসতে থাকে। এ কি? এ ছেলে না মেয়ে? আর ছেলে হলেও চুল অমন বড় কেন? সে সমাজের নিয়ম জানে না? মাঝেমধ্যে নিজেকে কাফকার তৈরি কিছু চরিত্রদের মতো লাগে। সারাক্ষণ যেন সত্ত্বার সন্ধানে হাঁসফাঁস করে বেড়াই। চুল বড় রাখতে গিয়ে যেন সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেলাম।
ছোটবেলা থেকেই আমাদের শিখানো হয় কোনটি ছেলেদের আর কোনটি মেয়েদের। গোলাপি মেয়েদের রঙ, ছেলেদের হতেই পারে না! পুতুল খেলা মেয়েদের, ক্রিকেট ছেলেদের। জন্মের পর থেকে আমরা নিজেরাই নির্ধারণ করে দেই ছেলেমেয়েরা কি পরবে, কি খেলবে আর কিভাবে চলবে। তাই সমাজের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে গেলেই বিপত্তি। তখন সাহস করে রীতি ভাঙ্গতে গেলে তাকে অচ্ছুৎ, অসামাজিক এবং অসভ্য বলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন হাজার ইচ্ছার সত্ত্বেও একজন নিজের মতো থাকতে পারে না।
আমি আমার আগের লেখাতে চলাফেরা, কথাবার্তায় কোনটি মেয়েলী, কোনটি ছেয়েলী তা নিয়ে আমার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি। ঘুরেফিরে একই রকমের বিষয় নিয়ে আবারও কথা বলছি। মানুষজন খানিকটা বিরক্ত হতেই পারে। বলতে পারে, আর কি কোন বিষয় নেই? পাত্তা না দিলেই হয়! দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়তেই হয়। একবার যদি আমার অবস্থান থেকে আমার গ্লানিগুলো পরোখ করে দেখতে পারলে হয়তো তেমন জোর দিয়ে মন্তব্য করতে পারতো না তারা।
গেলো এক বছরে রাস্তাঘাটে, শপিং মলে বা ইউনিভার্সিটিতে নানাভাবে মানুষের হাসির পাত্র হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বিকট আকার ধারণ করবে সেটা আমার কাম্য ছিল না। একবার রিকশা দিয়ে যাওয়া সময় পাশে রিকশায় থাকা দুটো ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘এই ছেলের এতো চুল বড় কেন? তুমি কি ছেলে নাকি মেয়ে?’ তারা হাসতে লাগলো, কিন্তু আমি তাদের দিকে তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। দুটো রিকশা দ্রুত বেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
আরেকদিনের কথা। রাতের অন্ধকারে বেড়িয়েছিলাম ওষুধ কিনতে। গলি অন্ধকার ছিল বলে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। গলির শুরুতেই কিছু পাড়ার ছেলে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। আমাকে দেখতেই শিষ দিল এবং অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করা শুরু করলো। আমি কিছুই বললাম না।
কিন্তু এরপরের ঘটনা সবকিছুকে ছাপিয়ে দেয়।
সেদিন এক ফুড কোর্টে বসে আছি। মুভি দেখতে এসেছি, বসে বসে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। মুখ ঘুরিয়ে বসার কারণে পিছনে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করেই বিকট আওয়াজের হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। আমি বই পড়ায় মনোযোগ দিলাম। চিৎকার চ্যাঁচামেচির শব্দ ধীরে ধীরে বেড়েই চলল। আমি পিছন ঘুরে দেখলাম প্রায় ২৫-২৬ জনের মতো কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের আখড়া। তাদের বিষয় হল আমি। স্পষ্ট শুনতে পেলাম কয়েকজন বলছে, ‘ঐটা মাইয়া নাকি পোলা? যা দেখে অ্যায়। মাইয়া তো জোস’। এক ছেলে এসে আমাকে দেখে গেলো। তারপর সেখানে গিয়ে কি যেন বলল। তাদের মধ্যে আবারও হাসির জোয়ার। একজন বলল, এইটা মাইয়া হইল না ক্যান? পোলা মানুষে এরকম চুল রাখে? আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। তারমধ্যে এক ছেলে ঠিক আমার বরাবর এক চেয়ারে এসে বসলো। ওই গ্রুপ থেকে তখন চিৎকার করে আরেক ছেলে বলল, ওই তুই ওইখানে ক্যান? তুই কি গে? অ্যায় হায়! রেইনবো নাই আমাগো দেশে’। আমি হন্তদন্ত করে উঠে গেলাম।
আপনারা হয়তো পড়ে বিরক্ত হতে পারেন। এই ছেলে কি মেরুদণ্ডহীন, এই ছেলের কি সাহস নেই – এই বলেও গাল দিতে পারেন। স্বাভাবিক। জী, আমি পারেনি আমার আওয়াজ উঠাতে। আমি পারিনি তাদের সঙ্গে লড়তে। আপনাদের একটা প্রশ্ন করি, যদি আমি তাদের সঙ্গে লড়তাম তাহলে আশেপাশের মানুষ কি আমাকে সাহায্য করতেন? না করতেন না। উলটো ভাঁড়ের পাত্র হিসেবে সাবস্ত্য হতাম। ছেলে মানুষ আবার কিভাবে হেনস্তার শিকার হয়? আদৌ কি তা সম্ভব?
অবশ্যই।
আমি এইভাবে যে প্রতিদিন লাঞ্ছিত হই সেটার বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। তবে সবচে বড় ব্যাখ্যা হল আমরা সমাজে কিভাবে মেয়েদেরকে ‘বস্তু’ হিসেবে দেখি। অনেকেই গলা বাড়িয়ে বলে, কিসের ওইমেন্স রাইটস? কিসের স্ট্র্যাগল? তাহলে দেখুন শুধুমাত্র চুল বড় রেখেছি বলে মেয়ে তকমা দিয়ে সমাজ কি করার চেষ্টা করছে। যেন ‘মেয়ে’ রুপী সবাইকে উত্যক্ত করা যায়, যেন মেয়েদের উত্যক্ত করা জায়েজ। নিজেদের পুরুষত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে মেয়েদের উপর আঙুল তুলে হাসিঠাট্টা করতে বিবেকে লাগে না। কারণ তাদের কাছে মেয়েরা তো বস্তু! আমাকে মেয়ে বলুক, আর হিজড়াই বা বলুক তারচে বড় কথা মানুষ কিভাবে এ দুটোকে কিভাবে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। তবে যে শুধু পুরুষ মানুষের কটু কথা শুনতে হয় তাও নয়। অনেক মেয়েই আছে যারা নিজেরা কটূক্তি করে নিজেদেরকে ছোট করতে আনন্দ পায়।
আমি ফেইসবুকে প্রায়ই ঘৃণামূলক মেসেজ পাই। তাদের অনেকের কথা, আমি কেন পুরোপুরি মেয়ে হয়ে যাই না আবার হিজড়া বলে নিজেকে দাবি করি না কেন। আমি পুরুষ জাতির জন্য কলঙ্ক! আর কজনের কঠিন আদেশ, চুল কাটো। বি অ্যা ম্যান!
যেন এই ‘চুল’ ছেলে আর মেয়ের মধ্যে একটি গাঢ় রেখা টেনে রেখেছে। রেখার ওপর পাশে গেলেই বিপদ।
মাঝেমধ্যে জবাব দিতে গিয়েও চুপ করে যাই। ভাবতে থাকি কিই বা হবে জবাব দিয়ে? আমি তো একদিনের মধ্যেই সমাজ বদলে ফেলতে পারবো না। ওদিকে আমার ধৈর্যও শক্তিরও অবনতি হচ্ছে ধীরে ধীরে। দাঁত কিড়মিড় করে রাগ প্রকাশ করি অন্তরেই। দিনের পর দিন রাগ জমতে জমতে গ্লানিতে পরিণত হয়। একদিন না একদিন উপচে পড়ে ফেটে যাবে।
একদিন না একদিন, কোন না কোন সময় হয়তোবা কোন না কোন এক সমাধান আসবে। সবকিছু সহ্য করে টিকে থাকার লড়াই করে যাওয়ার মধ্যে সার্থকতা আছে।
কথায় আছে না, যে সয় সে রয়।
