তানভির অনয়
ছোটবেলায় বড় বোনের হাতে প্রচুর মার খেতাম। খামচা খামচি করে রক্তাক্ত অবস্থা তৈরি হতো। আমি প্রতিহত করতে পারতাম না। শুধু কাঁদতাম। আম্মু আমাকে এসে রক্ষা করতো। মাঝেমধ্যে আম্মু বলতো, তুই ওমন গাধার মতো মার খাস কেন? নিজেকে বাঁচাতে পারিস না? আমি কোন উত্তর দিতাম না। সেই খামচির দাগ নিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুলের সব ছেলেগুলো আমাকে নিয়ে মজা করতো। বাজে বাজে কথা বলতো। বলতো আমি নাকি ছেলে নই। তাই তারা আমার নাম দিয়েছে ‘হাফ লেডিস’। যতই উপরের ক্লাসে উঠতে থাকি ততই নামের মধ্যে পরিবর্তন আসা শুরু করে। প্রথমে ছিল ‘হাফ লেডিস’ পরে ‘ফুল লেডিস’ তারপরে ‘লেডিস’ এবং সর্বশেষে ‘হিজড়া’ উপাধি পাই। আমি কি এ নিয়ে প্রতিবাদ করেছি?
করেছিলাম।
আমি ক্লাস থ্রিতে একটি বড় স্কুলে ভর্তি হই। বিশাল ক্যাম্পাস। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্র পরতে আসতো। তবে ‘বয়েজ’ স্কুলে পড়ার স্বাদ তিক্ততায় পরিণত হয়। চুপচাপ থাকতাম বলে খুঁচিয়ে মজা পেতো তারা। সবসময় আমার অঙ্গভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তুলতো। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতাম বলে গালি দিতো। গালি দিতে জানতাম না বলে ঠাট্টা করতো। তাদের অনুযায়ী আমি পুরুষ নই। সমাজের নিয়ম অনুসারে পুরুষদের যেসব গুণ থাকার কথা সেগুলোর একটিও আমার মধ্যে নেই। শুধু শরীরটা ছেলেদের, আর বাদবাকি সব আচরণ মেয়েদের মতো। প্রথম প্রথম চুপ থাকলেও পরে প্রতিহত করার চেষ্টা করি। ফলাফলঃ মার খাওয়া। তাদের সঙ্গে আমি পেরে উঠতে পারতাম না।
তখন পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। কয়েকবার ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ার সুযোগ পেয়েছি এবং হয়েছিও। প্রত্যেকবার লাঞ্ছিত হয়েছি বাকি ছাত্রদের কথায়। একটা মিনিটের জন্যেও তাদের মুখ দিয়ে একটা ভালো কথাও বের হতো না। আমি অনেকবার তাদের বুঝাতে চেষ্টা করছিলাম, ‘বারবার মেয়ে মেয়ে আমাকে বোলো কেন?’ তাদের কোন বিকার নেই। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, গলদটা কি আমার মধ্যেই? আমি ছকের বাইরে? খেলাধুলার মধ্যে নেই, সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে রাখি। গলার স্বর উঁচু করে কথা বলতে পারি না। গতানুগতিক ছেলের একটি মাত্র আচরণ আমার মধ্যে নই। তাহলে কি আমি আসলেই ছেলে নই? আমি কি আসলে একজন মেয়ে? তারপর আরও ভাবলাম। ভাবতে ভাবতে স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠলাম। প্রশ্নের উত্তর তখনও পাইনি। আমি আমার সত্ত্বাকে নিয়ে চিন্তিত। কিছু মাসের মাথায় কম্বাইন্ড কলেজে আমার অনেকগুলো মেয়ে ফ্রেন্ড হয়। তাদের সঙ্গেই উঠা-বসা। তাদের সঙ্গেই কথা বলাতে আনন্দ খুঁজে পাই। তাই বলে ছেলে ফ্রেন্ড যে ছিল না বলে তা দাবি করবো না। তবে খুবই অল্প কিছু ছিল। ভাষা ও চিন্তাধারার জন্যে বেশীরভাগ ছেলের সঙ্গে মিশতে পারতাম না। ওহ তার সঙ্গে খোঁচাখোঁচি তো আছেই। আমার এই কর্মকাণ্ড দেখে কলেজে নতুন উপাধি পেলাম আর সেটা হল ‘আপু’। কিছু মানুষের ধারণা হল আমি প্লে-বয় টাইপ, কিছুজন বলাবলি করার শুরু করলো, আমি ভাব দেখাতে মেয়েদের সঙ্গে চলি। আবার কিছুজন বলল, সমগোত্রীয়দের সঙ্গে ঘুরবো না তো কি করবো আমি? অতএব আমার কলেজ লাইফও পণ্ড। আমি কলেজে যাতায়াত কমিয়ে দেই। তখন আমি বাস্তবতার সম্মুখীন করতে অসক্ষম ছিলাম। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমাকে মেয়ে বলাতে আমি অপমানবোধ করি কেন? পুরুষ বলে অপমানিতবোধ হয়? মহিলারা পুরুষদের মতো আচরণ করলেও সমস্যা নেই, কিন্তু পুরুষরা যদি করে তাহলেই ঝামেলা! একধরণের হতাশা, বিষাদ কাজ করতে থাকে। কিছু মেয়েরাও আমাকে ইঙ্গিত করে বলতো, তুমি মেয়ে নাকি?
মেয়েদের আচরণ, ছেলেদের আচরণ বলে যে আলাদা করছে সমাজ আসলেই কি আচরণ কি লিঙ্গের উপর নির্ধারণ হয়? হয়তো বেশীরভাগ পুরুষ একধরণের আচরণ করে তাই বলে সেটাই কি বেদবাক্য? সেভাবেই অন্যান্য পুরুষদের আচরণ করতে হবে? একই জিনিস মেয়েদের ক্ষেত্রেও কাজ করে। আমি আমার মতো আচরণ করছি। এখানে লিঙ্গ টেনে নিয়ে আসা হবে কেন? আমি একটা সময় মেয়ে, হিজড়া বা অন্যান্য কথা বললে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতাম না। আমি জানি মৌনতা সম্মতির লক্ষণ, কিন্তু আমি কাদের বুঝাব? আমি কিভাবে এদের বুঝাবো? যাদের সমাজ নিয়ে মাথাব্যথা নেই, যারা এক ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে চলে তাদের বুঝাব? যাদের একটা সঠিক কথা বলতে গেলে দশটা গালি খেতে হবে। আগে এমনটাই ভাবতাম।
কিন্তু এখন নয়।
আমি একবার আমার পুরুষত্ব প্রমাণ করার জন্যে কিছু ছেলের সামনে জোর করে সিগারেট ধরিয়েছিলাম। কাশতে কাশতে ফেলে দেওয়ার পর শুনতে পেলাম, তারা আমাকে নিয়ে মজা করছে। তারা হাসছে আর বলছে, আজকাল মেয়েরাও সিগারেট খেতে পারে। আর এ তো…!
শুকনা, চিকনচাকন চেহারা নিয়েও এই সমাজ আমাকে গাল দিয়েছে। তাল-পাতার সেপাই বলে হেসেছে। আবার কেউ কেউ ধমকস্বরে বলেছে, ওজন বাড়াতে। বুক ফুলিয়ে হাঁটতে। কাধ সোজা রাখতে। বই পোকা ভাব কমাতে।
আমার চলাফেরা, আমার পোশাক-আশাক, আমার আচরণ নিয়ে সবার মধ্যে বিরক্ত কাজ করতে থাকে। আমি এমন কেন? ঘাড় নিচু করে হাঁটি, ঢোলা জামাকাপড় পরি। ট্রেন্ড বহির্ভূত জিনিসপত্র করি। শুধুমাত্র স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা নয়, আমার পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তিত। আমার কোন কিছুই পুরুষসুলভ নয়। আবার অনেকে বলে মেয়েসুলভও নয়। তারপর অনেকে বলা শুরু করলো হিজড়াসুলভ।
কিন্তু নিজেকে শক্ত করতে সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। অনেকবার কেঁদেছি, নিজেকে গাল দিয়েছি। খোদাকেও দোষারোপ করতে কুণ্ঠিতবোধ করিনি। পুরুষদের মতো আচরণ করার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছি। তবে দিন শেষে এক নকল আমিকে আবিষ্কার করতে পেলাম। সমাধান আসেনি।
আমি একটা সময় নিজেকে ছকে ফেলতে পারতাম না। বাক্সবন্দি লাগতো নিজেকে। একটা সময় অমানুষও দাবি করতাম। কিন্তু আমি এখন পারি।
কারণ, আমি আমার নিজস্ব ছকে অবস্থিত।
কথাগুলো শুনতে ভালো লাগলেও বাস্তবতা একটু নয় বেশ ভিন্ন। আজও সমাজের কাছে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হই। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা সবসময় সফল হয় না। তুই ‘এমন’ কেন প্রশ্নের উত্তর মানুষজন কৌতূহলী হয়ে শোনার অপেক্ষায় থাকে। আমি উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যাই। ইচ্ছা করে না।
তবে, আমি হলাম আমি। আমি কারোর মতো নই। আমি আমার মতোই।
