আসেফ আব্দুল্লাহ
ধর্ষণ। এটি কি শুধুই একটি শব্দ? শুধুই একটি অপরাধ?
আমি বলবো ধর্ষণ একটি ঘৃণ্যতম অপরাধ যা একজন মানুষকে শারীরিক ও মানুষিকভাবে ধ্বংস করে দেয় কখনো বা নিঃশ্বাস কেড়ে নেয়।
দেখা যায় বললে ভুল হবে, আমাদের অজান্তেই অনেকে ধর্ষণের স্বীকার হয়েও সমাজ ও আদালতের সম্মুখীন হতে হবে বলে বিষয়টা সয়ে যায়, কিম্বা যথা সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে ধর্ষকরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কারণ কী? দেশে কি ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন নেই? উত্তর হলো আছে।
মানুষ কি ধর্ষণের বিচার পায় না? এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি অবশ্যই অনেক অমীমাংসিত ধর্ষণের মামলা আমার মুখে ছুঁড়ে মারতে পারেন।
তবে আমাদের দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে। কিছুদিন আগেও এই আইন ধর্ষণের ভিক্টিম এর পক্ষে কম, অভিযুক্তর পক্ষে ছিল বেশি। নারীবাদের কল্যাণে অনেকটাই এখন ভিক্টিম এর পক্ষে।
উপরে ধর্ষণ সম্পর্কে আমার মতামত বলেছিলাম। তবে জানেন তো রাষ্ট্র আর আইন আমার আপনার মতামতে চলে না।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ নং ধারা অনুযায়ী;
কোন পুরুষ অতঃপর উল্লেখিত ব্যতিক্রম ভিন্ন অপর সকল ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পাঁচটি যেকোনো অবস্থায় কোন স্ত্রীলোকের সাথে যৌনসংগম করলে সে ধর্ষণ করেছে বলে পরিগণিত হবে।
১. স্ত্রীলোকটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে । অথবা
২. স্ত্রীলোকটির সম্মতি ব্যতিরেকে। অথবা
৩. স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে মৃত্যু বা জখমের ভয় প্রদর্শন করে স্ত্রীলোকটির সম্মতি আদায় করা হলে। অথবা
৪. স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমেই, যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানে যে, সে স্ত্রীলোকটি স্বামী নয়, এবং পুরুষটি ইহা জানে যে, স্ত্রীলোকটি তাকে এমন অপর একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে, যে পুরুষটির সাথে সে আইন সম্মত ভাবে বিবাহিত হয়েছে বা বিবাহিত বলে বিশ্বাস করে । অথবা
৫. স্ত্রীলোকটির সম্মতিক্রমে অথবা সম্মতি ব্যতিরেকে, যতি স্ত্রীলোকটির বয়স চৌদ্দ বৎসরের কম হয়।
এখানে না উল্লেখ করলে পাপ হবে যে, যৌনাঙ্গ অনুপ্রবেশ হলে তা যৌন সহবাস অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হবে এবং তা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে।
উপরের এই ধর্ষণের সংজ্ঞায় আমার অনেক সমস্যা রয়েছে। এখানে ম্যারিটাল রেপের কোনো স্কোপ নেই। এছাড়াও ধর্ষণ শুধু নারীর হয় না , পুরুষের ও হয় এই মতবাদে আইনী সংজ্ঞার তীব্র সমালোচনা করা যেতে পারে। আমি আজ করছি না। আপনারা করবেন অবশ্যই।
এখন একটু শাস্তির কথা বলতে হয়। আমাদের সাধারণ আইন অর্থাৎ দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অনুসারে, ধর্ষণের সাজা হল সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা এবং কোন ব্যক্তি যদি তার ১২ বছরের কম বয়সী স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তবে একই সাজা হবে। তবে তারা ১২ থেকে ১৩ বছরের মধ্যের বয়সী স্ত্রীকে ধর্ষণ করে সেক্ষেত্রে তারা সাজা হতে পারে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা দুটোই।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে। ব্লাস্টের(Bangladesh Legal Aid Services Trust) গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা ৮৫ ভাগ মেডিকেল সনদে ডাক্তার নিজে ভিক্টিম এর বয়স সুনির্দিষ্ট করে দিচ্ছেন। চিকিৎসক বয়সের সীমানা ৮ থেকে ১১ বছর এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে স্পষ্ট করে লিখছেন, বয়স ১৩ বছর। আর এই নির্ধারণে ভিকটিমের শারীরিক বৈশিষ্ট্যাবলি, যেমন তার স্তন, তার যৌনকেশ ইত্যাদি বয়স নির্ধারণের বাহ্যিক নির্ধারক হিসেবে কাজ করে থাকে। ধর্ষণের পুরুষালি বাস্তবতায় দেখা যায়, প্রায় ২০ শতাংশ মেডিকেল সনদে নারীর সম্মতি-অসম্মতি আইনি জটিলতা এড়াতে ধর্ষিত নারীর বয়স ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, ব্লাস্টের সংগৃহীত মেডিকেল সনদের প্রায় ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে ভিকটিমের উল্লিখিত বয়স আর পরীক্ষক চিকিৎসকের উল্লিখিত বয়সের পার্থক্য গড়ে তিন থেকে পাঁচ বছর। এমনকি গাজীপুরের একজন সাত বছরের ধর্ষিত মেয়েশিশুর বয়স মেডিকেল সনদে ১৫ বছর উল্লেখ করা হয়েছে। এমনই একটি ঘটনা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ধর্ষণের অভিযোগ আনয়নকারী শিক্ষার্থী নারীটির মেডিকেল এভিডেন্সেও দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে জন্মসনদ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থী নারীর বয়স ১৪ থেকে বাড়িয়ে ১৬ বছর হিসেবে মেডিকেল সনদে দেখানো হয়েছে। বয়স বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনকাঠামোর ৩৭৫ ধারা আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অনূর্ধ্ব ১৪ এবং অনূর্ধ্ব ১৬-এর সম্মতি-অসম্মতির ঊর্ধ্বে থাকাটাকে খারিজ করে ভিকটিম নারীর অসম্মতিকে কোর্টের পরিসরে বিতর্কিত চেহারা দেওয়াটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
আপাতত আইনি ফাঁকফোকর আর জটিলতা থেকে একটু সরে আসি।
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ নং এর আওতায় ধর্ষণ মামলার কতগুলো ধাপ রয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে প্রথমেই অফিসার ইনচার্জ (OIC) এর কাছে FIR দাখিল করতে হবে। থানার ইনচার্জ একজন তদন্ত অফিসারের উপর তদন্তের ভার ন্যাস্ত করবে তারপর সেই তদন্ত অফিসার প্রথমে সরকার স্বীকৃত মেডিকেল অফিসার দ্বারা অভিযোগকারীর মেডিকেল পরীক্ষার ব্যাবস্থা করবেন। নির্দেশ হয়েছে যে মেডিকেল পরীক্ষা ঘটনা ঘটার ২৪ ঘন্টার মধ্যে করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩২ ধারা মোতাবেক নিপীড়নের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে কিংবা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বেসরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের উপর দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০০ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সরকার এবং ডেনমার্কের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যৌথ অর্থায়নে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (OCC) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ২০০২ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশে সহিংশতার স্বীকার ভিকটিম বিশেষত ধর্ষণ ও এসিড দগ্ধাদের মেডিকেল পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি ফরমেট প্রণীত হয়। এই পরিপত্রের নির্দেশাবলী মতে ধর্ষিত নারী থানায় মামলা না করল কর্তব্যরত চিকিৎসক ধর্ষিতাকে চিকিৎসা সেবা দিতে বাধ্য থাকবেন।
আর এই ফরমেটেই সারাদেশে ধর্ষণ মামলার মেডিকেল প্রমাণ সংরক্ষণের আদেশ দেওয়া হয়।
এই ফরমেটে রয়েছে:
১. ভিকটিমের বেসিক শারীরিক বিবরণ;
২. অভিযোগকারীর নাম ও ঠিকানা;
৩. মেডিকেল পরীক্ষার জন্য ভিকটিমের প্রদেয় সম্মতি। এই সম্মতির জন্য সাক্ষ্য দেবেন অপর দুই ব্যক্তি;
৪. পরীক্ষার সময় ও তারিখ:
৫. নারী সহকারীর নাম ও ঠিকানা;
৬. ঘটনার বিবরণ- বিশেষত ঘটার সময় ও তারিখ, স্থান ও ঘটনার সংক্ষিপ্তসার বর্ণনা;
৭. শরীরী গড়নের পরীক্ষণ-ওজন, উচ্চতা, দাঁতের গঠন;
৮. শনাক্তকরণ চিহ্ন;
৯. বলপ্রয়োগের কোনো চিহ্ন।
ধর্ষণের জন্য বিশেষভাবে নির্দেশিত বিষয়াবলি
১. রজঃচক্রের বিবরণ:
২. বৈবাহিক অবস্থা:
৩. সন্তানের সংখ্যা
৪. যৌনকেশের বিবরণ:
৫. স্তনের গঠন ও প্রকৃতি:
৬. পেটের গড়ন:
৭. যৌনাঙ্গের সবিশেষ বিবরণ। যার মধ্যে আছে যোনিছিদ্র, যোনিবেড়, যোনিপথের বিবরণ আর এই পরীক্ষণের জন্য টু ফিঙ্গার টেস্ট সম্পাদিত হয়:
৮. এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, প্যাথোলজিক্যাল ও ডিএনএ পরীক্ষা:
৯. চিকিৎসান্তে অবমুক্তির তারিখ ও সময়:
১০. উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোনো হাসপাতালে প্রেরণের পরামর্শ:
১১. পরীক্ষক/চিকিৎসকের পরামর্শ ও মন্তব্য:
১২. পরীক্ষক/চিকিৎসকের স্বাক্ষর ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর।
পুলিশের মতে গড়ে প্রতিবছর তিনহাজার তিনশো ব্যাক্তি ধর্ষণের ভিক্টিম হয়ে থাকলেও ২০০৯ সালে সারাদেশে উপজেলা পর্যায়ে মাত্র তিনটি ধর্ষণের মেডিকেল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এরপর ধর্ষণের মেডিকেল পরীক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তুলে ধরি। বাংলাদেশের বৃহৎ নারীবান্ধব ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারটিতে ধর্ষণের মেডিকেল পরীক্ষার একটি স্বাভাবিক অংশ হিসেবে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ সম্পাদনা করা হয়।
নিশ্চয়ই টু ফিঙ্গার টেস্ট একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া? চলুন জেনে নেই।
হিউমান রাইটস ওয়াচের (২০১০) মতে, ‘টু ফিঙ্গার টেস্টে চিকিৎসক তার এক বা একাধিক হাতের আঙুল ধর্ষণের সার্ভাইভার নারীর যোনিদেশে
প্রবেশ করিয়ে সতীচ্ছেদের উপস্থিতি পরীক্ষা করেন, যোনির ঘনত্ব ও বেড় পরীক্ষা করেন’। এই টু ফিঙ্গার টেস্ট দিয়ে চিকিৎসক নির্ধারণ করে থাকেন ‘মেয়েশিশু’ ও নারীটি ‘কুমারী’ কি না, কিংবা যৌনসঙ্গমে অভ্যন্ত কি না। মেডিকেল পরীক্ষায় যখন উল্লেখ করা হয় পরীক্ষিত নারীটি যৌনসঙ্গমে অভ্যস্ত, আদালতকক্ষে এর মানেটা দাঁড়ায় ধর্ষণের সময় অভিযোগকারী ‘কুমারী’ ছিল না। যেহেতু কুমারী নয় সে কারণে ভিকটিমের প্রতি একধরনের সামষ্টিক বা পাবলিক সন্দেহ তৈরি হয় এবং এই পাবলিক সন্দেহ নারীটির আনীত অভিযোগের পাল্লাকে হালকা করে দিতে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। কারণ সতীরই কেবল ধর্ষণ হয় ;বেশ্যার ধর্ষণ হয় না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেছেন, এই নামে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কোন পরীক্ষা নেই।
কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের শারীরিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে আদালত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশে এই পরীক্ষা করাতে হয়। দেশের সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর ফরেনসিক বিভাগে এই পরীক্ষা হয়।
মিঃ মাহমুদ বলছেন, হাতে গ্লাভস পড়ে নারীর একান্ত প্রত্যঙ্গে আঙুল প্রবেশ করিয়ে তার ‘টেন্ডারনেস’ পরীক্ষা করা হয়। এই টেস্টের নামই ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’।
টু ফিঙ্গার টেস্ট আপাতদৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক বলে আমার কখনো মনে হয়নি। কার হাতের আঙুল কত মোটা, কার হাতের আঙুল কত পাতলা তা আমরা জানি না। হাতের আঙুলের গঠন ব্যক্তি সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার যোনি ঢিলা নাকি টাইট এটাও আপেক্ষিক ব্যাপার। কোনো ভিকটিম নারীর যোনিদেশে প্রবেশিত চিকিৎসকের আঙুল শক্ত ঠেকল নাকি সহজে ঢুকে গেল এসবই একেবারে ব্যক্তিনিষ্ঠ সাবজেক্টিভ মূল্যায়নের বিষয়।
ব্লাস্ট এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রার গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই পরীক্ষা পাঁচ বছর থেকে শুরু করে যে কোন বয়সের ভিকটিমের ক্ষেত্রে সম্পাদন করা হয়। এমনও হয়েছে যে ৬ বছর বয়সে একজন মেয়ে শিশুর মেডিকেল পরীক্ষার পুরোটা সময় সে চিৎকার করে কান্না করে গেছে এবং তার টু ফিঙ্গার টেস্ট পরীক্ষনের পর ফলাফল আসে ‘হেবিচুয়েট টু সেক্স’।
এ গেল টু ফিঙ্গার টেস্ট। সত্যি সত্যিই এই টু ফিঙ্গার টেস্ট বিদায় হয়েছে। দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষাপদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারীপক্ষ ও দুই চিকিৎসক রিট আবেদন করেন। এতে দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষার পদ্ধতি সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৩৫ (৫) ও সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার পরিপন্থি দাবি করা হয়। তারপর দীর্ঘ পাঁচটি বছর নারীবাদের ধৈর্যশীল লড়াই এর পর এই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল কয়েক দফা নির্দেশনাসহ টু ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর ২০২৩ সালের ২৪ শে আগস্ট বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি এ কে এম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ আটটি সুস্পষ্ট নির্দেশনাসহ ‘দুই আঙুলের পরীক্ষা’ বা ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন। নারীবাদীদের সাফল্য গুলোর মধ্যে এটি একটি। টু ফিঙ্গার টেস্টের মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী একটি প্রক্রিয়া নিষিদ্ধকরণ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে নারীবাদের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান।
কিন্তু ধর্ষণ আইন কি এখনো নারীবান্ধব?
এখানে আমি উনিশ শতকে যেতে চাই। বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থাপনার একটি সাধারণ দিক হলো বিভিন্ন আইনকানুন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। ধর্ষণ বিষয়ে প্রায়শই সতেরো শতকের প্রধান বিচারক ম্যাথুউ হলের বরাত দেওয়া হয়। তার বক্তব্যে ‘ধর্ষণ হলো এমন একটি অভিযোগ, যে অভিযোগ করাটা সহজ, প্রমাণ করাটা কঠিন এবং তার চেয়েও এই অভিযোগ প্রতিহত করা অধিকতর কঠিন, যদিও যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি কখনোই অত ভালো থাকেন না।’ লর্ড হেল আরও মন্তব্য করেন, ‘ধর্ষণ মামলা হলো সেই মামলা যেখানে অভিযুক্ত নন; বরং ভিকটিম স্বয়ং বিচারে বা ট্রায়ালে থাকেন। লর্ড হেলের এই বক্তব্য ধর্ষণ মামলার আইনি সংস্কৃতিতে (বর্তমান সময় পর্যন্ত) প্রভূত প্রভাব রাখতে সক্ষম হয় এবং ১৮৭২ সালে ঔপনিবেশিক শাসনামলেই ভিক্টোরিয়ান যৌনতার ধারণার ওপর ভিত্তি করে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ধারার ৪ নম্বর উপধারায় বলা হয় ‘কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার অথবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যাইতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা’।
এই ধারা অনুযায়ী নিম্নলিখিত উপায়ে বিরুদ্ধপক্ষ বা আদালতের অনুমতি নিয়ে সাক্ষী আহ্বানকারী পক্ষ সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা অভিশংসন করতে পারেন:
১. যেসব লোক সাক্ষ্য দেবেন যে ওই সাক্ষী সম্পর্কে তাহাদের যাহা জানা আছে, তাহাতে তাহার সাক্ষীকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলিয়া মনে করেন, তাহাদের দ্বারা সাক্ষ্য দেওয়াইয়া
২. সাক্ষীকে ঘুষ দেওয়া হইয়াছে, অথবা সাক্ষী ঘুষের প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছেন অথবা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অন্য কোনোরূপ দুর্নীতিমূলক প্রলোভনের প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছেন, তাহা প্রমাণ করিয়া:
৩. তাহার প্রদত্ত সাক্ষ্যে যে অংশ প্রতিবাদ সাপেক্ষ তাহা তাহার পূর্ববর্তী বিবৃতির সহিত সংগতিহীন, তাহার প্রমাণ করিয়া:
৪. কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার অথবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যাইতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।
বাংলাদেশের সমাজে নারী পিতৃতন্ত্রের ‘অধস্তন’ ক্যাটাগরি এবং পুঁজিবাদী শ্রেণিবৈষম্যের নিপীড়িতদের একজন হিসেবে অবদমনের সামনে পড়েন। পুরুষালি মতাদর্শের সমাজে নারী ‘ভোগের বস্তু’ আর এই ধারণা নারীর ওপর পরতের পর পরতের নিপীড়ন চালায় (শুভ্রা, ২০০৮)। ‘ভিকটিম’ থেকে ‘সার্ভাইভারে’ পৌঁছানোর মাঝে নারী নানান নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন এবং বিবিধ কাঠামোগত নিপীড়নের সম্মুখীন হন। এই বাস্তবতায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ ধর্ষণ মামলায় ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫-এর ৪ উপধারার ভিত্তিতে অভিযুক্তদের কোনো শাস্তি হয় না। ২০১৩ সালের অপর একটি পরিসংখ্যানগত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের শহর অঞ্চলে শতকরা ৯৫ ভাগ এবং গ্রামাঞ্চলে শতকরা ৮৮ ভাগ পুরুষ তথ্য দেন যে তারা নারী বা কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করলে কোনো রকম আইনি প্রক্রিয়া বা বিচারের সম্মুখীন হননি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে ২০১২ সালের ৯০৪ টি ধর্ষণে অভিযোগ পুলিশের কাছে করা হয়। একই সময় আইন ও সালিশ কেন্দ্রে তথ্য থেকে দেখা যায় ২০১০ সালে রিপোর্টকৃত ৪৪৬ টি ধর্ষণের ঘটনা থেকে কেবল ২৪৪ টি মামলা পুলিশ গ্রহণ করে। অর্থাৎ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে আনিত অভিযোগের শতকরা ৫৪.৭ ভাগ আদতে পুলিশ মামলার জন্য গ্রহণ করেছে।
এখানে অনেক গুলো কারণ রয়েছে। সত্যিকারের ধর্ষিতা নারী কেমন হবে তার একটা মিথ প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে। আর এখানেই ধর্ষণের ভিকটিম নারীরা সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার কাছে হেরে যান। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা ব্যবহার করে যে মামলায় ভিকটিম পক্ষে ও রায় প্রদান করা হয় সেগুলো স্বয়ং পুরুষ তান্ত্রিক ধারণা বিদ্যমান থাকে।
২০১৩ সালে টু ফিঙ্গার টেস্টের পাশাপাশি এই ১৫৫ ধারার ৪ নং উপধারার উপর রিট করা হয়েছিল।২০২২ সালের নভেম্বরে এসে ১৫৫ ধারার সংশোধনী সংসদে পাশ হয়। আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলায় জেরার সময় ভুক্তভোগীকে তার চরিত্র ও অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না- এমন বিধান যুক্ত করে ঔপনিবেশিক আমলের সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। এ ছাড়া বিচারকাজে বিভিন্ন ডিজিটাল তথ্যকেও সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ এই আইনে যোগ করা হয়েছে। ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০২২’ নামে এই বিলটি পাশের জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন।
এই সংশোধনী পাশ হওয়ার ফলে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা বাতিল হবে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।
পাশ হওয়া আইনে ক্রস এগজামিনেশন বা জেরার সময় প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলার ভিকটিমকে তার নৈতিক চরিত্র বা অতীত যৌন আরচণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না। ন্যায়বিচারের স্বার্থে যদি আদালত মনে করেন এই ধরনের প্রশ্ন করা প্রয়োজন, তাহলে আদালতের অনুমতি নিয়েই কেবল তা করা যাবে।
২০২২ সালের ২০ শে নভেম্বর এই সংশোধনীতে বলা হয় ,” Act No. I of 1872 এর section 155 এর সংশোধন। উক্ত Act এর section 155 এর sub-section (4) বিলুপ্ত হইবে।”
বাংলাদেশের ধর্ষণ আইনে এটি একটি বড় সাফল্য। নারীবাদের কল্যাণে বাংলাদেশের ধর্ষণ আইন এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি নারীবান্ধব। এখানে ভিক্টিম এর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগটা বন্ধ করা হয়েছে। টু ফিঙ্গার টেস্ট এর মত একটি অবৈজ্ঞানিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী প্রক্রিয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি এটাকে নারীর বিজয়ের কম কিছু মনে করি না।
কিন্তু শেষ প্রশ্নটি হলো একজন ধর্ষিত নারী, ভিক্টিম নারী কী এখন আইনে ন্যায়বিচার পাবে?
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আইনের সঠিক ও কঠোর প্রয়োগ কি নিশ্চিত হবে? নারী কি তার ন্যায্য অধিকার পাবে?
উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তবে আমি তনু, নুসরাত, মুনীয়া, আনুশকা বাংলাদেশে ধর্ষিত সকল নারীর জন্য ন্যায়বিচার দাবি করছি।
উত্তর যদি ‘না’ হয় তবে আমি বাংলাদেশে ধর্ষিত সকল নারীর ধর্ষকের মৃত্যু কামনা করছি।
তথ্যসূত্র:
১. আমি কি নারীবাদী – ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা
২. https://bangla.thedailystar.net/news/bangladesh/news-412031
৩. https://www.bbc.com/bengali/news-43743219.amp
৪. https://www.prothomalo.com/bangladesh/rknmrneka6
5. Why do some men use violence against women and how can we prevent it? Quantity findings from the UN multi-countries study on men and violence in Asia and the Pacific ,UN study,10 September 2013.
