বীর চট্টলার শেকল ভাঙার পদযাত্রা

Posted by

·

শিক্ষার্থী-জনতার রক্তস্নাত বিপ্লবের ফসল হিসাবে দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন হলো। এতোদিন ধরে আমরা পিতৃতান্ত্রিক এবং নিপীড়নমূলক যে ক্ষমতা কাঠামো দেখেছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে সেই সংস্কৃতি পরিবর্তিত হবে তো? সেই দাবী জানাতেই, ২০২৪ সালে ‘বীর চট্টলার শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ প্রথমবারের মতো রাজপথে নামছে।

আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি যেখানে নারীদের নিয়মিতই হয়রানি ও সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয়। অন্যদিকে স্বৈরাচারী সরকারের বিচারব্যবস্থা ধনী ও ক্ষমতাবানদের অপরাধগুলো থেকে পার পাইয়ে দেয়ার চেষ্টায়ই সর্বদা ব্যস্ত থাকে। ফলে নারীদের ওপর কাঠামোগত নিপীড়ন হয়ে পড়ে একটি নিত্তনৈমিত্তিক বিষয়। আমরা মনে করি, নারী নিপীড়নের এই চর্চা কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা হিসেবে বিচ্ছিন্ন নয়; বরং এই চর্চা রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থা দ্বারা বৈধকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই চলতে থাকে। ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন, যৌন হয়রানি প্রতিনিয়ত যেমন পথে, ঘরে ঘরে হচ্ছে, তেমনি ঘটে চলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রেও। এতোকিছুর পরেও আমরা দেখেছি, সাবেক সরকারের আমলে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে কিংবা উপযুক্ত শাস্তি দিতে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। বরং সরকারের আচরণে মনে হয়েছে, নিয়মিত এই নিপীড়নই বুঝি রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার অংশ। স্বাধীনতার এত বছর পর, নাগরিক অধিকার, নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা এবং বিচারহীনতার এই ধারাবাহিকতা আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায় যে, পিতৃতন্ত্রের অধীনে সমস্ত ন্যায়বিচারকে দমন করাই কি তবে রাষ্ট্রের প্রচেষ্টা?

আমরা দেখেছি ৮ বছরেও তনু হত্যার কোনো ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি। আমরা দেখেছি ২৮ বছর ধরে চলা কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামী আনভীর কিভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মী দ্বারা নারী নিপীড়নের খবর পত্রিকার পাতায় খুবই পরিচিত। আমরা দেখেছি অবন্তিকাকে যৌন হয়রানি’র প্রতিবাদ করার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার পরিবর্তে, আরও মানসিক হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে হয়। প্রীতি উড়াংয়ের মৃত্যু নিয়ে আমাদের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোকে একদম নীরব থাকতে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলগুলোকে অথর্ব হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। রাতের বেলা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নারীরা রাস্তায় বের হলে হয়রানির শিকার হতে দেখেছি। আইনের দিকে তাকালেও আমরা দেখি, ১৮৭২ এর সাক্ষ্য আইনের চরিত্রহননকারী ১৫৫(৪) ধারা সম্মিলিতভাবে বহু প্রতিবাদের পর বাতিল করলেও, ধর্ষণের ভুক্তভোগী নারীর প্রতি একই রকম নিপীড়নমূলক চর্চার বিষয়টি যুক্ত হয় আইনের ১৪৬(৩) ধারার সাথে। ফলে নিপীড়ন কখনও কখনও হয়ে উঠছে আইনসিদ্ধ, আবার কখনও কাঠামোবদ্ধ বিচারহীনতা।

আমরা আশা করি, নতুন সরকার গঠনের সাথে সাথে এই ধরণের আইনসিদ্ধ নিপীড়ন, লিঙ্গীয় ও জাতিগত বৈষম্যমূলক চর্চা রাষ্ট্রকাঠামো থেকে বিলুপ্ত হবার পাশাপাশি নারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান নিশ্চিত হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের দাবি:

১। সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ-যৌন সহিংসতার সাথে যুক্তদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক ও ন্যায্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

২। সায়েম সোবহান আনভীর, শাফাত আহমেদের মত শিল্পপতি-ধনকুবেরদের নারী নিপীড়নমূলক অপরাধ বিচারের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অন্যায্যভাবে খারিজ হয়ে যাওয়া মামলাগুলো পুনঃতদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ (সংশোধিত) এর ১৪৬ (৩) ধারা পুনঃসংস্কার করার মাধ্যমে আইনের দিক সহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে যেকোনোভাবেই ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ (দোষারোপ করা/নিন্দা জানানো) বন্ধ করতে হবে।

৪। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদন্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আইনি ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন সংস্কার করতে হবে।

৫। মামলার ডিএনএ আইনকে সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে কার্যকর করতে হবে।

৬। সেনা প্রহরার পাহাড়ে নারীর উপর সংঘটিত সামরিক-বেসামরিক পুরুষদের যৌন সন্ত্রাসের খবরসমূহ গণমাধ্যমে আসার অবাধ প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণ, অভিযোগ যথাযথভাবে আমলে নেওয়া ও সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে পাহাড়ে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৭। হাইকোর্টের নির্দেশানুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সরকারি, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন বিরোধী সেল কার্যকর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। সিডো সনদে বাংলাদেশকে স্বাক্ষর ও তার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

৮। যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে প্রান্তিক অঞ্চলের নারীদের সুবিধার্থে হটলাইনের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। গ্রামীণ সালিশ/পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।

৯। প্রাথমিক লেভেল থেকেই পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা (গুড টাচ-ব্যাড টাচের শিক্ষা, সম্মতি বা কন্সেন্ট এর গুরুত্ব, প্রাইভেট পার্টস সম্পর্কে অবহিত করা) যোগ করার সাথে সাথে এর কার্যকরী পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।

১০। মাদ্রাসার শিশুসহ সকল শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কোন শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে ৯০ দিনের মাঝে দ্রুততম ট্রাইব্যুনালে অভিযোগের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

১১। কোনো নারী নিপীড়নের শিকার হলে অভিযোগ জানাতে গেলে থানা ও আদালতে পুলিশি ও অন্যান্য হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

১২। গণপরিবহনে নারীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে।

১৩। ধর্মীয় বক্তব্যের নামে অনলাইনে ও অফলাইনে নারী অবমাননাকর বক্তব্য প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আমরা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই; দিনে হোক বা রাতে, আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, নারী হিসেবে আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায় সরকারের। অপরাধ সংঘটিত হলেই “মেয়েরা এতো রাতে বাইরে কেন?” চলমান এই সামাজিক ট্যাবুর মুখ আমরা আজীবনের জন্য বন্ধ করে দিতে চাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের সকল দাবী একসাথে তুলে ধরতে চাই।

২৫ অগাস্ট রাত ১১ টা ৫৯ মিনিট থেকে শুরু হবে শেকল ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আমাদের এই পদযাত্রা। ২ নং গেইট টু নিউমার্কেট চত্ত্বর রাস্তায় আমরা হাঁটবো, গলা উঁচিয়ে প্রতিবাদ করবো, গান গাইবো, রাতের অন্ধকার ভেদ করে সবাইকে জানিয়ে দেব আমাদের দাবীর কথা।

নারীদের এ পদযাত্রায় অংশ নিতে পারবেন যেকোনো ‘নারী’৷ আপনি যদি লক্ষ্য করেন এই সমাজের বারংবার নারীদের নিষ্পেষিত করার প্রয়াস, আপনি যদি মুক্তি চান-স্বাধীনতা চান; একজন স্বাধীন নাগরিকের মতো অধিকার চান, এই পদযাত্রা আপনার জন্যই!

প্রস্তাবিত যাত্রাপথ: বিপ্লব উদ্যান-জিইসি-ওয়াসা- টাইগারপাস-রেলওয়ে স্টেশন-নিউমার্কেট মোড়।
নিউমার্কেট মোড়ে পৌঁছে সমাবেশ এবং প্রতিবাদী অবস্থান।

‘নারী, এবার তুমি শেকল ভাঙ্গো!’

যেকোনো যোগাযোগে:
০১৮৮২৮০৪৭৬৭ 

Event link: https://www.facebook.com/events/917904570145791/