আসেফ আব্দুল্লাহ
১)
হিজড়া কী? আমার পক্ষে এটার এক বাক্যে উত্তর সম্ভব নয়। তবে আমি এটা বলতে চাই হিজড়া শুধুই Intersex নয়।
বাংলাদেশে হিজড়াকে আমি একটি আমব্রেলা টার্ম বলতে চাই। হিজড়া এমন একটা সামাজিক বর্ণালী যার মধ্যে সমকামী মানুষ থাকতে পারে, ইন্টারসেক্স থাকতে পারে এমনকি উভকামী মানুষও থাকতে পারে। হিজড়া এমন একটি আইডেন্টিটি যার মধ্যে বিভিন্ন যৌনতার,বিভিন্ন ধরনের, এমনকি বিভিন্ন জেন্ডারের মানুষ পাওয়া সম্ভব। হিজড়া একটি সংস্কৃতিও আবার এটি একটি ঐতিহ্য।এই সব মিলিয়ে আমাদের দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী। সাদা কালোর বাইরের মানুষজন তারা। Beyond binary.
আবার আমরা যদি হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাই তো আমরা শুধুই হিজড়া পাবো না। হিজড়াদের মধ্যে আবার অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। আমরা হিজড়াদের মধ্যে আবার ছিবড়ি, আকুয়া, কতি, ধুরানী,ভাবরাজ, জেনানা, ছিন্নীসহ আরো কয়েক ধরণের হিজড়া আমরা পাবো।
আপাতত আমি হিজড়াদের মধ্যে প্রচলিত কিছু শব্দ নিচে ব্যাখ্যা করছি। এই নিবন্ধটি পড়তে এগুলোর অর্থ জানা দরকার।
জেনানা – নারী সাজে সজ্জিত হিজড়া
আকুয়া – যে পুরুষ নারী সাজে সজ্জিত হয়ে মানসিক সুখ পায়
ভাবরাজ – ইন্টারসেক্স
কতি – বায়োলজিক্যাল ছেলে কিন্তু আচার আচরণ কথা বার্তা মেয়েদের মতো এমন হিজড়া
ধুরানী – যে হিজড়া সেক্স করে টাকার বিনিময়ে
ছিবড়ি – স্বাভাবিক নারী হিজড়া
ছিন্নী – যে হিজড়া পুরুষ থেকে নারী হওয়ার জন্য নিজের Penis ছেদন করে বা সার্জারি করে।
পান্থি – পুরুষ মানুষ
পারিক – প্রেমিক পুরুষ
ধুরপিট – সেক্স করা
বাটলী – পাছা Butt
লিগাম – Penis
চিশ্যা – সুন্দর/সেক্সি
ঠিকরি দেয়া – তালি দেয়া
বুটলী মাসি – এনাল সেক্স
২)
আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে হিজড়াদের ইতিহাস আজকের নয়। প্রাচীন যুগ থেকেই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষের অস্তিত্ব ছিল এই ভারতীয় উপমহাদেশে যার বিভিন্ন প্রমাণ আমরা প্রাচীন ভারতীয় মিথলজি ও সাহিত্যে দেখতে পাই। এখানে আমি লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যময় মানুষ বলছি কারণ হিজড়া শব্দটি সমাজে তখন ছিল না এবং এই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষদের বর্তমান সময়ের মত কোণঠাসা করে রাখা হতো না। তখন নারী-পুরুষের ভেদাভেদ যে খুবই বেশি ছিল এমনটাও নয়। ভিনসেন্ট স্মিথ, রোমিলা থাপার প্রমুখ বিশিষ্ট ঐতিহাসিকদের মতে বেদের যুগে নারী পুরুষের মধ্যে কোনো রকম ভেদাভেদ ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের পোশাক পরিচ্ছদের বিভাজ্যতা অপসৃত হয়েছিল। নারী পুরুষ উভয়ই লম্বা চুল রাখত। উভয়ই গহনা ব্যবহার করত, বস্ত্রের নীচে ‘নীবি’ জড়িয়ে বাঁধত। আর তাদের সাথে ভিন্ন যৌনতার, লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষেরা একই সমাজে একসাথে বাস করত।
ধারণা করা হয়, তখনও সমাজে খোঁজাদের অস্তিত্ব ছিল। বৈদিক গ্রন্থ গুলিতে এর তেমন প্রমাণ মিলে নি। প্রাচীন ভারতে খোজা এবং ভিন্ন যৌনতার মানুষ (সমকামী, উভকামী,অ্যাসেক্সুয়াল) যে ছিল এ কথা ড. এ.এল. ব্যাশাম তাঁর The wonder that was India গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন । প্রথম দফায় যাদের খোঁজা বানানো হতো এদের হারেম পাহারা দেওয়ার জন্য খোঁজা হতে হতো না। কারণ হারেম অনেক পরে এসেছে মুঘল সময়ে।
যে শূদ্র বিছানায় অথবা আসনে ব্রাহ্মণদের সমকক্ষ হতে চায় অথবা রাস্তায় ব্রাহ্মণকে সমকক্ষ ভেবে তার সঙ্গে তদ্রূপ ব্যবহার করে তার একশত ‘পণ’ জরিমানা হবে। ব্যভিচার তখনও ছিল, বৈদিক সমাজ খুব একটা শুচিশুদ্ধ ছিল না। যে যুগের সাহিত্য ঘাঁটলে উচ্চবর্ণের মানুষের অবৈধ প্রণয়ের কথা প্রায়শই পাওয়া যায়। এমনকি নিম্নবর্ণের নারীদের সঙ্গে সহবাস করতেও এরা কুণ্ঠা বোধ করত না। কিন্তু কোনো শূদ্র ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে সহবাস করলেই তা দোষাবহ বলে পরিগণিত হতো এবং তার শাস্তিস্বরূপ এই লিঙ্গচ্ছেদ। বলাবাহুল্য শাস্তি-ভীতির পরও বহু শূদ্র এমন আচরণ করত। ড. এ.এল. ব্যাশাম খোঁজাদের প্রাচীন ভারতের অন্যতম অপ্রীতিকর চিত্র (unpleas- ant feature) বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে খোঁজারা সংখ্যায় লঘিষ্ট হলেও একেবারে অজানা ছিল না। তাদের সাথে রূপান্তরকামী, সমকামী মানুষদের অস্তিত্বও ছিল। আর আন্তলিঙ্গ দের উল্লেখ ও আমরা পাই বিভিন্ন জায়গায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে সমকামী, উভকামী, রুপান্তরকামী মানুষের অস্তিত্ব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। তারপর ইসলামী সংস্কৃতির মিশ্রণে খোঁজাকরণ এই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষদের মধ্যে কেন যেন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুলতানী ও মুঘল শাসনামলে খোঁজাদের দিয়ে হারেম পাহারা দেয়া হতো। এই বিষয়টা আমরা সবাই জানি। কিন্তু খোঁজাদের কাজ শুধু হারেম পাহারা দেয়াতেই ছিল না। সুলতানের যৌনসামগ্রী হিসেবে তাদের কদর ছিল। তারা সেবা করা , ফুট ফরমাশ খাটা এমনকি গুপ্তচরের কাজেও নিযুক্ত ছিলেন। মুঘল সম্রাট বাবরের সময় ‘নাজির’ হিসেবে রাজদরবারে এই মানুষদের উপস্থিতি ছিল। সেই আমলে খোঁজা করণ ব্যাপক সাড়া পেলে এই অঞ্চলে খোঁজাকরণ প্রক্রিয়া ছড়িয়ে পরে। ভারতীয় হিজড়াদের বিকাশ ঘটে মূলত সেই সময়েই। হিজড়াদের মধ্যে লিঙ্গচ্ছেদ বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনেকেই তখন থেকে লিঙ্গচ্ছেদ করে বর্তমান ছিন্নীতে পরিণত হয়।
৩)
আমাদের এই উপমহাদেশের হিজড়ারা সবথেকে বড় সমস্যার সম্মুখীন হয় ইংরেজশাসন আমলে। ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলের লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর ওপর আরোপ করা হয় ‘ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট ১৮৭১’। তৎকালীন ব্রিটেনের লিঙ্গ বৈচিত্র্যের ধারণা ছিল ভীষণভাবে বাইনারি, তাই ব্রিটিশ অনুশাসনকালে এই অঞ্চলের লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর ওপর আরোপণ করা হয় ব্রিটিশ ক্রিমিনাল ট্রাইব অ্যাক্ট ১৮৭১। এর ২৪, ২৬ ও ২৯ ধারা অনুসারে বলা হয়, যদি কোনো পুরুষ ‘মেয়েলি আচরণ’ করে, মেয়েদের মতো পোশাক পরিধান করে, প্রকাশ্যে মেয়েদের পোশাক পরে নাচ, গান করে তবে তাকে ক্রিমিনাল হিসেবে গণ্য করা হবে। এরই মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষ জনগোষ্ঠীকে ‘সামাজিক ক্যাটাগরি’ থেকে পরিণত করা হয় ‘লিগ্যাল ক্যাটাগরিতে’ যেখানে তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয় অপরাধী তথা ক্রিমিনাল হিসেবে। ১৯৪৭ সাল-পরবর্তী পাকিস্তানে এই ধারা অব্যাহত থাকে। আইয়ুব খানের শাসনামলে তাঁদের (হিজড়া) রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করা হয়। একপর্যায়ে হিজড়া নেতারা আইয়ুব খানের বাসার সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন। তাঁরা আইয়ুব খানের মায়ের কাছে আবেদন করেন, যাতে তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ ঘোষণা করা না হয়। মায়ের অনুরোধে আইয়ুব খান নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি সংস্থা ও পশ্চিমা দাতা সংস্থার আগ্রহে এইচআইভি/এইডস প্রসঙ্গে এই জনগোষ্ঠীকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। এর ফলে এই জনগোষ্ঠী আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে। আর ব্রিটিশদের শেখানো সভ্যতায় বাংলাদেশে বাইনারির ধারণা প্রবলভাবে গেঁড়ে বসে।
তবে বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের স্বীকৃতি দিতে যেয়ে ২০১৩ সালে একটি কান্ড করে বসে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারীতে প্রকাশিত গেজেটের এক প্রজ্ঞাপনে একটি মাত্র বাক্যে বলা হয়েছে যে, ‘সরকার বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে হিজড়া লিঙ্গ (Hijra) হিসেবে চিহ্নিত করিয়া স্বীকৃতি প্রদান করিল।’ এক বাক্যের একটা স্বীকৃতি।
সরকারের এই বিষয়ে কোন গবেষণা নেই, কোনো তথ্য নেই। আশেপাশের দেশগুলো করেছে তাই বাংলাদেশের সরকার ও করল। ভারত আলাদা আলাদা ভাবে বাইনারির বাইরে বাকিদেরকে Third Gender হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা তাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে যায়নি। আবার নেপাল বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা ফিলিং বেসড জেন্ডার এপ্রোচ করে। এমনকি পাকিস্তান সরকার তাদের দেশের সকল খুজরা (ইন্টারসেক্স) , খোজাসিরা (খোজা) , ট্রান্সম্যান ও ট্রান্সওম্যানকে স্বীকৃতি দিয়েছে তৃতীয় লিঙ্গ (Gender) হিসেবে। এমনকি তাদের জন্য Transgender Persons (protection of rights) Act 2018 আইন পাশ করেছে। এমনকি ২০১৬ সালে পাকিস্তান শরিয়াহ বোর্ড ট্রান্সজেন্ডার বিয়ে বৈধ বলে ঘোষণা দেয়। তবে কয়েকটি ইসলামপন্থী দল এ নিয়ে রিট করায় বিষয়টি এখনো কার্যকর হয়নি। আবার আরেকটি ইসলামিক রাষ্ট্র ইরানে রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠীর লিঙ্গ পরিবর্তনের বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত এবং রাষ্ট্রীয় খরচে তা বহন করা হয়। অর্থাৎ সেখানে সেক্সুয়াল রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি রাষ্ট্রীয় খরচে সম্পাদন করা হয়। কারণ ওখানে বিশ্বাস করা হয় এমন ব্যক্তি ‘‘Trapped in a wrong body’’।
আমাদের সরকার যেটা করেছে সেটা হলো বাইনারির বাইরে কিছু মানুষকে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু হিজড়া যে একটা লিঙ্গ নয়। এ উপমহাদেশে নারী ও পুরুষ ভিন্ন ঐতিহাসিকভাবে দৃশ্যত ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এক লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী হচ্ছে হিজড়া জনগোষ্ঠী। ক্রোমোজোম বা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে যারা জন্মগ্রহণ করেন তারাই কেবল হিজড়া, এই ধারণা ভীষণ রকমের একপেশে এবং ভ্রান্ত। হিজড়া এই উপমহাদেশীয় লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর একটি ‘আমব্রেলা টার্ম’।
বাংলাদেশ সরকারের হিজড়াদের হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া অনেক সমস্যার তৈরি করেছে। সরকারিভাবে হিজড়াদের উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হলেও সেটা বলবৎ হয়না একারণে। হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় অনেক হিজড়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ সরকারিভাবে শুধু ইন্টারসেক্স বা যাদের সেক্স ক্রোমোজম বায়োলজিকাল নারী বা পুরুষের মতো নয় তাদেরই হিজড়া বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কতি, আকুয়া, জেনানা, ছিন্নী, ছিবড়িসহ অনেক হিজড়া বঞ্চিত হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি দরদ দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে যে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড করেছে, তা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে নিম্নমান অফিস সহকারী পদে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে চৌদ্দজন হিজড়াকে বাছাই করা হয়। ইন্টারভিউ নেয়ার পর যোগ্যতার ভিত্তিতে এদের মধ্যে থেকে বারোজনকে চাকরিতে নিয়োগের জন্যে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়। মেডিক্যাল পরীক্ষায় দেখা যায় যে, এই বারোজনের মধ্যে এগারোজনেরই লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ রয়েছে। এ কারণে তাদেরকে হিজড়া হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। একমাত্র লিঙ্গহীন যে একজন প্রার্থী ছিল, সে একজন লিঙ্গচ্ছেদকারী। ফলে ওদের কাউকেই চাকরি দেওয়া হয়নি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তারা সকলেই না-কি বায়োলজিক্যাল মেইল।
৪)
হিজড়া হচ্ছে এই অঞ্চলের লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী। তাদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আচার আচরণ রীতিনীতি। হিজড়া সংস্কৃতির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো গুরু চেলা। এটি একটি সংস্কৃতি, একটি গুরুপরম্পরা সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিতে বিভিন্ন যৌন ও লিঙ্গীয় পরিচয়ের লোকজন বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নারী-পুরুষদের বাইরে লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের জনগোষ্ঠী ‘হিজড়া’ হিসেবে পরিচিত। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষ আছে। তবে বাংলাদেশে ইসলামী এবং হিন্দু ধর্মের অনুসারী বেশি। আগে হিজড়ারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে বর্তমানে তাদের জীবিকার পথ সীমিত। হিজড়াদের মধ্যে মায়া, মমতা দুঃখ কষ্ট সকল প্রকার অনুভূতিই সাধারণ মানুষের মতো। তবে যেটা তাদের কিছুটা আলাদা করে তোলে সেটা হলো লজ্জাহীনতা। দীর্ঘদিন হিজড়া ডেরায় থেকে থেকে তাদের মনস্তত্ব এমন হয়ে যায়। অশ্লীলতা গালিগালাজ হিজড়াদের নিত্যদিনের বিনোদন। আগে গ্রাম্য বধুরা হিজাড়াদের ডেকে এনে তাদের খিস্তি শুনে আমোদ করত আর যে যা পারে ডাল, চাল, টাকা পয়সা দিতো। বর্তমানে সুশীল মানুষেরা যথাসম্ভব তাদের এড়িয়ে চলে । তাই কোথাও বাচ্চা হলে হিজড়ারা চলে যায় তোলা আদায় করতে। হিজড়াদের জীবনপ্রবাহ অনেকটাই আলাদা। প্রতিটি হিজড়ার জীবন শুরু হয় নির্বাসন দিয়ে বাসা থেকে নির্বাসন। তবে বেশিরভাগ হিজড়াই নিজের ইচ্ছায় কখনো বা সমাজের চাপে হিজড়াদের আস্তানায় এসে হাজির হয়। এসে তাদের নামকরণ করা হয়। নামকরণ হিজড়া সংস্কৃতির একটি প্রধান অনুষঙ্গ। যেমন কারো নাম হয়তো ছিল রাকিব সরকার এখন হয়তো তার নাম হবে রাখী কিংবা রাণী। হিজড়াদের অন্যতম ঐতিহ্য হচ্ছে ঠিকরি দেয়া। তারা ছল্লা খাটার সময় ঠিকরি দেয় , রাগ প্রকাশে ঠিকরি দেয় , ঠিকরি দেয়া হিজড়াদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
হিজড়া ডেরায় একজন গুরুমার অধীনে অনেকজন হিজড়া থাকে। হিজড়াদের মধ্যে ছিন্নি, আকুয়া, কতি, ধুরানীই বেশি থাকে। ভাবরাজের ছিবড়ি, জেনানা তুলনামূলক কম।আকুয়া হিজড়ারা নিজদের নারী ভাবতে খুবই পছন্দ করে। অনেকেই বিভিন্ন হরমোন, ওষুধ নিয়ে বুনি বড় করার চেষ্টা করে। হিজড়াদের যৌনজীবন ও বৈচিত্র্যময়। বেশিরভাগ হিজড়া বুটলী মাসি করে তাদের পারিক এর সাথে। তাদের কথাবার্তায় তারা তাদের যৌন জীবনের প্রতিফলন ঘটায়। হিজড়া ডেরায় যাওয়ার পর অনেক হিজড়াদেরই আনুষ্ঠানিকভাবে গুরুমার পছন্দের পান্থির সাথে রাত কাটাতে হয়। এক্ষেত্রে যে পান্থি বেশি টাকা দিবে তার অগ্রাধিকার বেশি। বর্তমানে কতি ধুরানীরা প্রায়ই ধুরপিট করে টাকা ইনকাম করার চেষ্টা করে। অনেক পুরুষ মানুষ কামসঙ্গী হিসেবে হিজড়া পছন্দ করে। সমকামী পুরুষেরা সুন্দর বাটলী ওয়ালা হিজড়া খোঁজে। কিন্তু হিজড়া যে সবসময়ই ধূর খায় এমনটা না। হিজড়াদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে।
“হিজড়া যেমন ধূর খাইতে পারে তেমনি ধুরাইতেও পারে।”
কারণ অনেক হিজড়ারই সক্ষম পেনিস থাকে।
প্রতিদিন হিজড়াদের ছল্লা খাটতে যেতে হয়। একেকদিন একেকজনের ডিউটি থাকে একেক জায়গায়। হিজড়াদের এই ছল্লা খাটা টাকার একটা অংশ দিতে হয় গুরুমাকে। অনেক আগে থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। কোথাও কোনো বাচ্চা হলে তারা চলে যায় তোলা আদায় করতে। আগে খুব সহজেই নতুন বাচ্চার বাবা মা হিজড়াদের টাকা দিয়ে দিত। বর্তমানে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। হিজড়াদের তাই বাধ্য হতে হয় তোলা আদায়ে। এছাড়াও হিজড়ারা এখনো গ্রামে গঞ্জে গান গেয়ে কিছু উপার্জন করে। তাদের এই গানকে হিজড়া গীত বলে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের গান করে থাকে তারা।
বিষ ভাতারি নারিকেল তেল আসবে জাহাজে
হেসে হেসে মাখব মাথায় বসবো বাগানে
কই শিং মাগুর মাছ ধরতে পারলাম না মনের মত ছেলে পেলে পয়সা নিতাম না বাতির কুপি বন্দি হয়ে পাতে হয়নি নুন
খেতে খেতে মনে পড়ে ছেলের বাপের গুন একখান দুইখান ঝিঙ্গা
বিষ ভাতারি নারিকেল তেল আসবে জাহাজে
আবার গ্রাম্য মহিলাদের সামনে গান করতে হলে,
মা তোমার কালো জামাই আর ভাল্লাগে না মা।
আজ দেখলাম ঐ পাড়াতে ছিড়ছে সজনে ডাটা
আরে পেট বাঁধায়া চইলা গেল ঐ গুদের বেটা
মা তোমার কালো জামাই আর ভাল্লাগে না মা।
আমার বাড়ি তোমার বাড়ি মাঝখানে বেড়া।
আরে ঐ পাড়ার কালো ছোড়া ঢুকিয়ে দিল বাড়া।
এরকম অনেক অনেক গান হিজড়াদের মুখস্থ থাকে। কোথাও বিয়ে হলে তারা বিয়েতেও টাকা তুলতে যায়। আবার নিজেদের মধ্যে উৎসব অনুষ্ঠানে তারা নিজেরাও নাচে।
আমাদের দেশের হিজড়াদের দেখে মনে হয় এরা খুবই সুখী। অনেকেই তো আবার বলে বেড়ান যে ওদের জীবনের মতো সুখ নাই। খাও দাও টাকা কামাও আর নাচা নাচি। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠটা খুবই ভিন্ন। হিজড়ারা থাকে পরিবার পরিজন ছেড়ে একলা। নিজেদের বলতে হিজড়া ছাড়া আর কেউ নেই তাদের। প্রতিদিন গালি শুনতে হয় সাধারণ মানুষের। রাস্তায় রোদে পুড়ে পুড়ে ছল্লা খাটা, অনেক অপমানিত হওয়া কিছু টাকার জন্য। বিভিন্ন যৌন রোগ তো আছেই। অন্যদের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে না পারা। চাকরীর সুযোগ নাই। মানুষ হিসেবে কেউ গণ্য করে না । তাদের ভেতরটা একদম শুন্য থাকে।
মানুষের মৌলিক অধিকার বলতে যা থাকার কথা তা তাদের বর্তমানে নেই। এই হলো বাংলাদেশের হিজড়াদের বর্তমান।
