স্বাধীনতা হারানোর যে ইতিহাস তা একই সাথে নারী কীভাবে তার অবস্থান হারিয়েছে এবং ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সেটারও ইতিহাস। কীভাবে আধিপত্যবাদী পুরুষ তার সমস্ত প্রভু ও দাস, শাসক ও অধীনস্থদের সাথে নিয়ে ক্ষমতা অর্জন করেছে এটা তার ইতিহাস। নারীর পতন, নারীর পরাজয় হলো সমগ্র সমাজের পতন ও পরাজয়। সেক্সিস্ট সমাজ ও সেক্সিস্ট পুরুষ নারীর ওপর তার সামাজিক আধিপত্য গড়ে তুলতে এতটাই উন্মত্ত যে সে তার সাথে সংঘটিত যে কোনো সংস্পর্শেকেই আধিপত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্র বানায়।
নব্য-উদারবাদী অর্থনীতির কল্যাণে সংবেদনশীল মধ্যবিত্ত সমাজ বর্তমানে নারীবাদকে ধারণ করে অলঙ্কারের মতই, ৫০০ টাকার উইমেন শাটল আর সোশ্যাল মিডিয়ার ২৮০ শব্দের অরাজনৈতিক নারীবাদী পোস্টের বাইরে এর বিশেষ কোন অস্তিত্ব নেই। শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও বৃহৎ রাজনৈতিক পরিসর থেকে বিছিন্ন নারীবাদী নান্দনিকতার ভিড়ে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তনের আলাপ হারিয়ে গেছে বহু আগেই। এই প্রেক্ষাপটে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারীবাদের প্রকৃত আদর্শিক ধারার একটি পুনরুথান আমরা দেখতে পাই। সমাজের সর্বস্তরের নারীরা একে অপরের, এবং বিশেষত শ্রমজীবী নারীদের অধিকার নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। নারীর জীবন সংগ্রামের গল্পগুলো শ্রেণীভেদে আলাদা হয়ে যায় স্রোতের মত। এই শত সহস্র স্রোতের মিলনের মাধ্যমেই একক কণ্ঠস্বরে রাষ্ট্র ও ক্ষমতা কাঠামোকে প্রশ্ন করা সম্ভব।
স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র আনার কথা বলা হয়, কিন্তু নারীর অবস্থার পরিবর্তন হয় না। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ কিংবা সামাজিক প্রথার দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র তার ব্যর্থতাকে অস্বীকার করে। অপরদিকে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে নারীবাদের রঙিন প্রলেপে পুঁজিবাদ গিলিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোগত অক্ষমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আড়াল করে রাখা হয়। অথচ নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের বর্তমানে অন্যতম হাতিয়ার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। মৌলিক চাহিদা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা পর্যন্ত যে সকল অধিকার নারীর জন্মগত, সেসবই আজ বাজারের পণ্য, এবং এই পণ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীর হাতের নাগালের বাইরে।
নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত না করে নারীর ক্ষমতায়ন করতে চাওয়া ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু না৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পুরুষতন্ত্রকেই পৃষ্ঠপোষকতা করে। পাশাপাশি, নারীকে রূপান্তর করে পণ্যে৷ নারীর সংকট দূরীকরণের উপায়গুলোও বাজারে পণ্য হিসেবে নিয়ে আসে৷ নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার বিক্রি করে মুনাফা অর্জনের ব্যবস্থা করে নব্য-উদারবাদী অর্থনীতি৷ যার সমসাময়িক উদাহরণ ‘উইমেন শাটল’৷ কেবল লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে গণপরিবহনে যাতায়াত করা নারীরা প্রতিদিনই হেনস্তা ও ভোগান্তির শিকার হয়৷ প্রতিদিন ৫০০ টাকার বিনিময়ে উইমেন শাটল ব্যবহার করে নারীরা তাদের নিরাপত্তা কিনতে পারবে এখন৷ এদিকে, নারী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন শ্রেণি পরিচয়ের পাশাপাশি বৈষম্যের শিকার হয় লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে৷ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলাফল কেন নারীরা ভোগ করতে পারছেনা? গণঅভ্যুত্থানের নারীরা কোথায় হারাল?
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। শুধু অংশগ্রহণই নয়, নেতৃত্বেও ব্যাপকভাবে ছিল নারীরা। আন্দোলনে ৪র্থ শ্রেণির নারী শিক্ষার্থীকে তার ১০ম শ্রেণির বোনের সাথে শাটডাউন কর্মসূচিতে অংশ নিতেও দেখেছি আমরা। আমরা দেখেছি রোকেয়া হলের নারী শিক্ষার্থীদের, যারা সমন্বয়কদের নয়-ছয় উপেক্ষা করে স্বৈরাচারকে স্বৈরাচার বলে স্লোগান দিয়েছে৷ নারীদের সম্মুখসারিতে থেকে আক্রমণের শিকার ও আহত হতে দেখেছি আমরা। কিন্তু, এতকিছুর পরও অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নারীদের কোণঠাসা করে দেওয়া হলো। একজন নারী সমন্বয়ককে যখন সাইবার বুলি করা হচ্ছিল বাকি সমন্বয়কদের নীরব থাকতে দেখতে হয়েছে আমাদের। ক্ষমতায় যারাই গেছে তারা কখনও নারীর জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নাই। অভ্যুত্থান-উত্তর সময়েও বিভিন্ন স্তরে নারীদের রিপ্রেজেন্টেশন বিলীন করে দেওয়া হয়েছে।
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে আমরা দেখেছি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি একজন নারী হওয়াকে তারা কীভাবে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বলে প্রচার করেছে। নারী বিদ্বেষসহ নানা বিতর্কিত ভূমিকার পরেও ‘তেঁতুল হুজুরের’ সঙ্গে শেখ হাসিনার সখ্যতা ছিল, তার কথায় পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করা হয়েছে৷ নারীর ক্ষমতায়নের বুলি আওড়ানো দলই সবচেয়ে পুরুষতান্ত্রিক আচরণ করেছে। শ্রমজীবী-মেহনতি ও নিম্ন শ্রেণির নারীদের কোনো ক্ষমতায়ন ঘটে নাই। রাষ্ট্র কাঠামোতে একজন নারী ক্ষমতা অর্জন করলেই গোষ্ঠী হিসেবে নারীর ক্ষমতা অর্জন হয় না। বরং, রাষ্ট্র কাঠামো, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় ক্ষমতায় আসীন নারীও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। এমনকি ভিন্ন মত এবং অধিনস্থ শ্রেণির নারীদের ওপর আধিপত্য প্রদর্শন, শোষণ, নিপীড়ন, অপদস্ত করতে ক্ষমতাসীন নারী পুরুষতান্ত্রিক উপায়ই অবলম্বন করে। যুগের পর যুগ নারীরা কয়েক স্তরে শোষিত হয়ে আসছে। ঐতিহাসিকভাবে রাষ্ট্র, পরিবার, ধর্ম, আইন, পুরুষ, উচ্চতর সামাজিক শ্রেণি, নিজের সামাজিক শ্রেণি এবং নিজের জেন্ডারের মানুষ দ্বারা শারীরিক, যৌন, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিপীড়িত হয়ে আসছে নারীরা। রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর অবস্থান অধস্তন (সাব-অর্ডিনেট)।
কখনও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ, কখনও ম্যোরাল পুলিশিং করে পুরুষতন্ত্রের শেকল দিয়ে নারীদের উপর বৈষম্য এখনও টিকিয়ে রাখা হয়েছে। নারীর উপর চলমান নিপীড়নের ঘটনায় সরকার নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। নির্লিপ্ত থাকছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার এতদিন পরও যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল কার্যকর হয় নাই৷ অনেক শিক্ষার্থীকে তার যৌন নিপীড়কের সাথে একই ক্লাসে বসতে হচ্ছে৷ প্রক্টর সমাধান দিচ্ছে জিডি করার৷ অথচ, কোনো রিভিউ কমিটির অস্তিত্ব আমরা দেখতে পেলাম না।
রূপপুর পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ না করে, পাটকল চালু না করে, প্লাস্টিক উৎপাদন কারখানা চালু রেখে কেবল সুপারশপে প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে যেমন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রো-এনভায়রোমেন্টাল ভেক ধরছ, এমন আই ওয়াশ উদ্যোগ ‘নারীদের ক্ষমতায়নের’ নাম করেও নেওয়া হয়ে থাকে। যেমন – নারীদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প। এই ঋণের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই ঋণের উপর নারীদের আদৌ কোনো অধিকারই থাকে না। একইভাবেই, সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন একটা টোকেনাইজেশন ছাড়া কিছুই না৷ অথচ, লিঙ্গ বৈষম্যের অন্যতম নিয়ামক হলো সম্পত্তি, সেই সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার নিয়ে সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই।
অভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হলেও ক্রমশ সবখান থেকে নারীদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতি থেকে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ, আদিবাসী এবং বিশেষ করে নারী গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। নিপীড়নের অবসান ঘটার যে আকাঙ্ক্ষা থেকে তারা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল সেই আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। যে রাজনৈতিক সংগ্রামের কেন্দ্রে নারী নেই, সেটা কোনো সংগ্রামই নয়। বর্তমান রাজনৈতিক উদ্যোগগুলো ঠিক একইভাবে নারী-বিবর্জিত। আলোচনা, তর্ক বা কথোপকথন — জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উন্মোচন এবং জনপরিসরে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত বৈষম্যবিরোধী আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। মানুষ ঠিক ততটুকুই স্বাধীন থাকে, যতটুকু সে লড়াই করে। অধিকার আদায়ও শুধু রাজপথ থেকেই হয়। তাই, নারীরা রাজপথ এবং রাত রিক্লেইম কর। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে পুরুষতন্ত্র গুড়িয়ে দাও, সংগঠিত হও, প্রতিরোধ গড়ে তোলো।
নারীর ওপর চলমান নিপীড়ন-সহিংসতা-ধর্ষণের বিরুদ্ধে এবং নারী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও সকল নারী নিপীড়ন মামলার দ্রুত বিচারের দাবিতে
