সময়ের প্রয়োজনে সময়: প্রসঙ্গ ট্রান্সজেন্ডার

Posted by

·

,

জয়া সিকদার 

মোঘল সাম্রাজ্যে ট্রান্সজেন্ডার মানুষের গ্রহণযোগ্যতা ছিল মোঘল সম্রাটদের কাছে। মোঘল সাম্রাজ্যের রাজশাসকের অনেক দায়িত্ব পালন করতেন এই ট্রান্সজেন্ডাররাই। এমনকি সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে যেত ট্রান্সজেন্ডারদের। ইতিহাস খুঁজলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে আপনারা এগুলি পাবেন, চলে আসি ব্রিটিশ শাসনে, মোঘল সাম্রাজ্যের পরাজয় হয় ব্রিটিশের কাছে ব্রিটিশরা তাদের বিভিন্ন ধরনের আইন কানুন দিয়ে বন্ধ করে দেয় ট্রান্সজেন্ডার মানুষের পথ চলা। তখন থেকে এই ট্রান্সজেন্ডার মানুষরা তাদের জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন ছদ্মরূপে নিজেদের আত্মপরিচয় তুলে ধরে তার ভিতরে রয়েছে হিজড়া, বৃহন্নলা, কিন্নর, আরাবানী, শিখন্ডী। 

ভারতবর্ষ মুক্তি পেয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে, এই আন্দোলনের পরই ১৯৪৭ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় ভাগ হলো হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে মুসলিমরা ভাগ হলো পাকিস্তানে আর হিন্দুরা ভাগ হলো হিন্দুস্থানে। ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরাও বিপ্লবী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন এবং হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন কিন্তু ইতিহাস তাদের নাম কখনোই লিখে নাই কেননা এর পেছনের কারণ হলো এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ট্রান্সজেন্ডার মানুষের আত্মপরিচয় প্রকাশে অনেক বাধা। ভাষাগত দিক থেকে পাকিস্তান দুই দিকে ভাগ হলো একটি হল পশ্চিম পাকিস্তান যাদের ভাষা উর্দু, আর পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হল বাংলা।  

সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের উপরে এক ধরনের নিপীড়ন শুরু করে তারই ধারাবাহিকতায় ৫২ ভাষা আন্দোলনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়ে শহীদ হলেন আমাদের ভাষা সৈনিকেরা। মুক্ত বাংলা স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু হল ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে। এই রক্তক্ষয়ী নয় মাসের যুদ্ধে খান সেনারা কেড়ে নিল মা-বোনদের ইজ্জত, আপনারা কি জানেন ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের ইজ্জত কেড়েছে তারা, তা কিন্তু ইতিহাসে লেখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে যে সকল হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার তাদের আত্মপরিচয় না থাকার কারণে তারা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ও পায়নি। কিন্তু জরিপ করে খুঁজে বের করা হয়েছে কয়েকজনের পরিচয়, তার ভিতরে মাস্টার রনি ও খুলনার পান্না হিজড়া। ইতিমধ্যে তাদের দুটি ডকুমেন্টারি বেরিয়েছে আপনারা হয়তো দেখতে পাবেন। কিন্তু কথা হল ভাষার জন্য আন্দোলন হল, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন হল কিন্তু এখনো বাংলাদেশ স্বাধীন হলো না। আমরা বিজয়ের কথা বলি আমরা স্বাধীনতার কথা বলি কিন্তু কোথায় স্বাধীন আমরা? আমাদের ধর্মান্ধতায় ঘেরা ধর্মযাজকদের কাছে আমরা এখনো বন্দী, তাহলে কোথায় আমাদের স্বাধীনতা? 

তুমি মুক্তিযুদ্ধ তুমি বলে দাও কোথায় আমাদের স্বাধীনতা? 

হে বীর বিক্রম হে বীরঙ্গনা তোমরা কি স্বাধীন করতে পেরেছ এখনো? 

এখনো আমরা ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজদের ফতোয়ায় আত্মপরিচয়ের খোলা জানালা খুলতে পারছিনা। যখনই আসে ট্রান্সজেন্ডার মানুষের আত্মপরিচয়ের কথা তখনই তারা তাদের ফতোয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আসলে এই ট্রান্সজেন্ডার মানুষ কারা? সে তো সৃষ্টিকর্তার রহস্য, তাকে কেন তাহলে তোমরা বিকৃতি মস্তিষ্কের মানুষ বলবে? 

মানুষের সকল চাওয়া পাওয়ার সাথে যৌনতা জড়িত নয় কিন্তু আমাদের ধর্মযাজকদের কথায় বারবার ফিরে আসে বিকৃতি মস্তিষ্কের মানুষ, সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছে তার সকল সৃষ্টির রহস্যের জন্য যাকে সৃষ্টি করেছে তিনি নিজেও তো এই রহস্যের মায়াজালে জড়িয়ে আছে, আপনারা এই মানুষগুলিকে তার মানবতার জায়গায় না নিয়ে এসে তাদেরকে সব সময় আপনারা ফেলে দিতে চান মানবেতর জীবন যাপনে। আজকে তারা পড়াশোনা করতে চায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। সুশিক্ষিত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতে চায় মানুষের কল্যাণে তারা কাজ করতে চায় ,সেখানে আপনারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিল করেন, মিটিং করেন তাদের জন্য বরাদ্দ শিক্ষা কোটা বন্ধের জন্য। এ কেমন দেশ? তাহলে কি বলবো এখন ও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। যদি বলি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ তাহলে সকল নাগরিকের সমান অধিকার। পুরুষতন্ত্র আর ধর্মযাজকদের ধর্মান্ধতায় ফতোয়ার উপর কি দাঁড়িয়ে থাকবে ট্রান্সজেন্ডার মানুষের অবস্থা?  

পড়াশোনা করে সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় ট্রান্সজেন্ডার মানুষরা আর আপনারা কিনা তাদেরকে অশিক্ষিত মূর্খ করে হিজড়া বানিয়ে রাস্তায় ট্রাফিক সিগনালে হাত বাড়িয়ে দিতে ব্যবস্থা করছেন। যিনি পড়াশোনা করেন তিনি তার আত্মপরিচয় সঠিকভাবে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আর যিনি পড়াশোনা করেনি তিনি হয়তো সমাজের ভয়ে ফতোয়ার ভয়ে নিজের আত্মপরিচয় লুকিয়ে অন্য পরিচয় দেয়। এ কেমন রাষ্ট্র যেখানে মানুষের উপরে ফতোয়া জারি করা হয় মানুষের আত্মপরিচয়ের কারণে। আমি একটি কথাই বলবো যে সারা দুনিয়া জুড়ে এই মানুষগুলি রয়েছে। যে দেশে সামাজিক স্বীকৃতি আছে সে দেশে মর্যাদার সঙ্গে মানুষগুলি বসবাস করছে, আর যেই দেশের সামাজিক স্বীকৃতি নেই সেই দেশগুলিতে তারা বিভিন্ন ছদ্ম পরিচয় বেঁচে আছে। একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক মর্যাদা দিলে তাদের আজ ছদ্ম পরিচয়ে বেঁচে থাকতে হয় না। একটি দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তারা রূপান্তরিত হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পারে। আজকে আপনারা দেখতেছেন পথে-ঘাটে, হাটে-মাঠে তারা তোলা তুলছে, এর পিছনে দায় কিন্তু আপনাদের।