নীলিমা নীলা
৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুদিন, রোকেয়া দিবস। গত কয়েকমাসে বেগম রোকেয়া কে অপমান করার অন্ততঃ দুটি চেষ্টার কথা জেনেছি। তাঁর ছবিতে অশ্লীল গালি লিখে রাখা বা ছবি মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। তাছাড়া কয়েকবছর ধরে উনার বিরুদ্ধে বইয়ের গ্রুপে অনেক লেখা মন্তব্য চোখে পড়েছে। যে নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি তার জীবন কাটিয়েছেন তাদের অনেকেও আজ তারই বিরোধিতা করেন, ব্যাপারটা দুঃখজনক। বছর পাঁচেক আগে বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী পড়ে মুগ্ধ হয়ে এই রিভিউটি লিখেছিলাম। সেকালের নারীদের অবস্থা বুঝতে হলে বইটি পড়তে পারেন কারো যদি ইচ্ছা হয়।
বইয়ের নাম: অবরোধ-বাসিনী
লেখক: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
কিছু হাসি আছে করুণ হাসি, দেখতে হাসি বলে মনে হলেও আসলে কান্না। অবরোধ-বাসিনী হচ্ছে সেই করুণ হাসির গল্প, গল্পই বা বলছি কেন, সত্যি সব ঘটনা। তাও বেশিদিন আগের না ৮০/৯০ বা ১০০/১৫০ বছর আগের। বেগম রোকেয়ার লেখা কেবল টেক্সটবুকেই পড়েছিলাম, এর বাইরে কখনো পড়া হয় নি, আর টেক্সটবুক মনোযোগ দিয়ে পড়েছি এমন মিথ্যে দাবী আমি করতে পারি না।
স্কুল জীবনে একজন স্যার ক্লাসে বলেছিলেন বেগম রোকেয়া এতো নারীবাদী হলে নামের শেষে সাখাওয়াত হোসেন মানে স্বামীর নাম পদবী লাগিয়েছিলেন কেন। ভেবেছিলাম তাই তো? এখন বুঝি সেকালের সেটাই নিয়ম ছিলো, তিনি যতোটুকু করে গিয়েছেন, একালের কয়টি মেয়ে তা করতে পারে। অবরোধ শুধু পোশাকের পর্দ্দা বা বোরকা না, শতাব্দীর পর শতাব্দী নারী জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া মনের পর্দাও।
বেগম রোকেয়া (সাখাওয়াত হোসেন টা বাদ ই দেই) সেই অবরোধে থাকা অসংখ্য নারীর গুটিকয়ের করুণ কিছু কাহিনী তুলে ধরেছেন। বোরকা আটকে যে অবরোধবাসিনী ট্রেন থেকে নামার সময় পড়ে গিয়েছিলেন, তাকে সাহায্য করার অধিকার ছিলো না কোন পুরুষের কারণ সেটা ধর্ম সমর্থন করে না, শেষে ট্রেনে কাটা পড়েই মরলো, আট পেরিয়ে নয়ে পা দেয়া কেবল মইয়ের দুই ধাপ উঠেছিলো বলে বাপের মার খেয়ে মর্ত্যলোকের মায়া ত্যাগ করলো, বিয়ের আগে মাসের পর মাস মাইয়াখানায় বাস করে অন্ধ হয়ে গেলো বিয়ের কনে, কিংবা পালকীতে উঠিয়ে দেশ দেখতে যাবার সময় কিয়েক প্রস্থ প্যাকিং করে মালগাড়ীতে চললো বিবিদের দল, ভাবা যায়?
গঙ্গা স্নানে গিয়ে পালকী শুদ্ধ পানিতে চুবানো কিংবা মেয়ে স্কুলের গাড়ীকে জাল আর পর্দ্দা দিয়ে ঘিরে আলমারী বিশেষ বানানো, আবার সেই দোষে ধর্মের ঝান্ডাধারীদের চরমপত্র পাঠানো হাসিই লাগে তবে, করুণ হাসি। একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম ইরানে নাকি সিনেমাতেও হয়তো আগুন লেগেছে এমন দৃশ্যে কোন পর পুরুষ কোন নারীকে হাতে ধরে উদ্ধার করছে এ দৃশ্য দেখানো যায় না, কেননা পর্দ্দাপ্রথার বিরোধী হয়ে যায় সেটা, এই বই পড়ে বুঝলাম এই কড়াকড়ি মোটেই ওসব দেশে অবাস্তব নয়।মেয়েদের পর্দ্দা শুধু পর পুরুষের সামনে ছিলো না, ছিলো মেয়েদের সামনেও।
পাঠান নারীর সামনে পড়ে এক মেয়ের পর্দ্দা নষ্ট হয়ে গেলো কেননা ঐ পাঠান মহিলা পাজামা পড়েছিলো পুরুষদের মতো। ভাবা যায়? পর্দ্দা প্রথা কি এখন আর তেমনভাবে নেই? হ্যা অনেকটাই বাস্তসম্মত হয়েছে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে, তবে কলের চাকা উল্টো ঘুরতে কদিন লাগবে? এখনো আফগানিস্তানে মেয়েরা কিভাবে আছে বা থাকে এই বই পড়ে সেই কথাই কল্পনা করলাম, একদিন এই দেশেও সেই দৃশ্য আবার দেখা যেতে পারে। তবুও একদল মানুষ বোরকা, পর্দ্দা সমর্থন করেই যাবে, এমনকি মেয়েরাও।
যেদিন মেয়েরা পুতুল থেকে মানুষ হবে সেদিন বোধহয় এই অবরোধ খসে পড়বে, তবে তার আগে মনের অবরোধটা খসে পড়া দরকার, জানিনা সেই সুদিন আদৌ আসবে কিনা, বা আসলেও আগামী শ, দুশো বছরের মধ্যে আসবে কিনা।
