নীলিমা নীলা
গত ১১ নভেম্বর ছিল Veterans Day। দিনটা ইউএস আর্মির সাবেক সদস্যদের সম্মানে পালিত দেশটির একটি বিশেষ দিবস। স্বাভাবিক ভাবে এ বিষয়ে আমার জানা থাকার কথা না, জানতামও না। জানলাম কয়েকটা গ্রুপে বেশ কয়েকটা পোস্ট দেখে। সবগুলোই ট্রান্সওমেনদের গ্রুপ যার বেশিরভাগ সদস্য ইউএসএ বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাগরিক। বয়স ২০ থেকে ৭০ সব বয়সের ই আছেন। এদের কেউ কেউ সেক্স চেঞ্জ প্রসেস শেষ করেছেন, কেউ তার মধ্যে আছেন কেউ বা এখনো এতটুকু এগোননি সবে কাম আউট করছেন।
খুব বড় নয় গ্রুপগুলো, কিন্তু সবসময়ই এক্টিভ। গ্রুপ সদস্যদের পোস্ট গুলো দেখতে, পড়তে ভালো লাগে। নিজের সম্পর্কেই এরা লেখেন, জার্নিটা বলেন, একটা সিস্টারহুড প্রত্যাশা করেন সমমনাদের। এখন পর্যন্ত কোনো দুঃখ ভারাক্রান্ত বিষাদগ্রস্ত কিছু ওসব জায়গায় পড়েছি বলে মনে হয় না। অন্যদের কাছে একটু একসেপটেন্স আর ভালোবাসা প্রত্যাশা করেই ওরা লেখেন কিন্তু সে সব তাদের তাদের দুঃখ গাঁথা নয় বরং বিভিন্ন অর্জনের হাসি মুখের ছবিসহ লেখা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এলজিবিটিকিউ মানুষের আনন্দের গল্প কমই পড়ি বা শুনি, বেশিরভাগই বিষাদের কথা। ওদের পোস্টগুলো পড়তে তাই বোধহয় আরো বেশি ভালো লাগে।
তো ১১/১২ তারিখের দিকে এসব গ্রুপে অনেক গুলো পোস্ট দেখেছিলাম যারা বায়োলজিক্যাল পুরুষ ছিলেন, সাবেক মার্কিন সেনা সদস্য এবং বর্তমানে লিঙ্গ পরিবর্তন এর প্রক্রিয়া শেষ করে নারী হিসেবে জীবনযাপন করছেন। তাদের কেউ এখনো তরুণ, কেউ মাঝবয়সী, কেউ প্রৌঢ়। ভিয়েতনাম থেকে ইরাক কি আফগানিস্তানে এরা যুদ্ধ করে এসেছেন। সেই সময়ের ইউনিফর্ম পরা ছবি আর বর্তমানের ছবি দিয়ে তারা পোস্ট করছিলেন। তখন একটা কথা মাথায় এসেছিল যা নিয়ে প্রায়ই ভাবি। এই মানুষগুলো আর্মিতে ছিলেন, সবাই যোদ্ধা হিসেবে ছিলেন কিনা জানিনা। তবে একটা প্রথাগত ধারণা নিয়েই তো বড় হয়েছি যে আর্মিতে যারা কাজ করেন তারা খুব সাহসী হিম্যান গোছের কেউ। এখন অবশ্য প্রায় সব দেশে নারী সেনারাও আছেন, তবু কোথাও যেন একটা প্রথাগত ধারণা রয়ে গেছে সাহস, বীরত্ব এসব পুরুষের বৈশিষ্ট্য।
আরো একটা ধারণা প্রচলিত দেখেছি মানুষের মাঝে যে ট্রান্সওমেন যারা কিন্তু ট্রানজিশন করেননি, তারা খুব মেয়েলি দেখতে এবং মেয়েলি আচরণ করেন। এখানে এই মেয়েলি টার্মটা ডিফাইন করা কঠিন। তবু আচরণের ক্ষেত্রে যেসব বায়োলজিক্যাল ছেলে বা পুরুষ একটু হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেন, কোমর দুলিয়ে হাঁটেন সাধারণত তাদের মেয়েলি বলা হয়। চেহারার ব্যাপারটায় ফর্সা, হালকাপাতলা, মাঝারি উচ্চতার কেউ যার চেহারায় একটা কমনীয়তা আছে এরকম কিছুও অনেকে মেয়েলি হিসেবে কল্পনা করে থাকেন।
চেহারা, উচ্চতা বা দৈহিক গড়নে মানুষের নিজের ভূমিকা তো নেই কিন্তু আচরণের ক্ষেত্রে আছে। যাদের মধ্যে উপরে আচরণগুলো লক্ষ্যণীয় তাদেরকে সাধারণভাবে মেয়েলি বলে ধরা হয় এবং এমন কয়েকজন মানুষ সম্পর্কে অন্যদের বলতে শুনেছি ওদের মধ্যে হরমোনের ইমব্যালেন্স আছে তাই ওরা এমন। কিন্তু এসব আচরণ কি মানুষ আসলেই হরমোনের প্রভাবে করে? এসব আচরণ কিন্তু সব বায়োলজিক্যাল নারীদের মধ্যেও দেখা যায় না। অধিকাংশই করেন হয়তো তবে সেটাও সম্ভবত সমাজের শেখানো পথে হাঁটা, শুধু শরীর বা হরমোনের প্রভাবে সম্ভবত নয়। সম্ভবত বলছি কারণ এটা আমার ধারণা মাত্র, নিশ্চিত কোনো উত্তর নয়। ট্রান্সরা কেন ট্রান্স হন তার নিশ্চিত একক উত্তর এখনো নেই। তবে মস্তিষ্কের গঠন, জেনেটিক কারণই হবার সম্ভাবনা বেশি সাথে হরমোনের প্রভাব থাকাও সম্ভব।
আমি জীবনে যে অল্প কয়েকজন ট্রান্সওমেনকে দেখেছি তাদের প্রায় সবার আচরণ এমন প্রথাগত নারীসুলভ ই। নিজেকে নারী হিসেবে আমিও আইডেন্টিফাই করি কিন্তু নিজের আচরণেও সম্ভবত এমন কিছু ধরা পড়ে না বা পড়তে দিতে চাইও না। তাই ভাবতাম আমিই কি আলাদা? একজন ব্যতিক্রম কেবল পেয়েছিলাম যার মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোঁফ। আচরণে এক ধরনের কোমলতা আছে কিন্তু রীতিমতো হ্যান্ডসাম একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ বলেই ওনাকে যে কারো কাছে মনে হবে, যদি উনি প্রকাশ না করেন যে নিজেকে উনি নারী হিসেবেই চেনেন জানেন। এরকম কাউকে দেখে খুশি হলেও অবাক মোটেও হইনি বরং নিশ্চিত হয়েছিলাম এই নিজের বিশ্বাসে যে নারীত্ব কেবল বাইরে থেকে বোঝার জিনিস না তার স্থান মনে। এটা প্রকাশ যেমন করা যায়, গোপন করে থাকাও আপাতভাবে সম্ভব।
আমার দেখা ঐ ফেসবুক গ্রুপগুলোর পোস্টগুলোর মানুষগুলোও তাদের মাচো ইমেজ নিয়ে জীবনের অনেকটা সময় ছিলেন তারপর কোনো একসময় নিজের এই সত্ত্বা প্রকাশ করেছেন, মন আর শরীরকে মিলিয়ে নিতেও প্রয়াস করছেন। নিজের পূর্ব এবং বর্তমান দুই পরিচয় নিয়েই তারা গর্বিত এবং এ নিয়ে কোনো হীনমন্যতা মোটেও প্রকাশ করতে দেখিনি। ইচ্ছা হয়েছিল তাদের কথা লিখি, কিন্তু ছবি ছাড়া লেখাটা অসম্পূর্ণ হবে মনে হয়েছিল। কিন্তু একটা প্রাইভেট গ্রুপে পোস্ট করা অন্য কারো ছবি তো আমি পাবলিকলি প্রকাশ করার অধিকার রাখি না। আজ এরকম ই একটা গ্রুপে এই মানুষটির বিফোর আর আফটার ট্রানজিশনের ছবিসহ একটা পোস্ট দেখে ভালো লেগেছিল। ওনার প্রোফাইলে গিয়ে দেখলাম পোস্টগুলো পাবলিক এবং শেয়ার ও হচ্ছে। এই ছবি বা পোস্ট এই লেখার সাথে সরাসরি সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও যা বলতে চেয়েছি তার সাথে অনেকটা বোধহয় যায়। সেই হিসেবে উনার পোস্টটা আমিও শেয়ার করে রাখলাম লেখার সাথে: https://www.facebook.com/100072277435460/posts/571949758557600/?app=fbl
