সাত পাকে ‘বাঁধা’ – হিন্দু বিবাহ আইন ও ডিভোর্স

Posted by

·

প্রিয়াংকা অধিকারী

বিয়ে, একটি বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দু’টি মানুষের মাঝে দাম্পত্য জীবনের শুরু হয়। কেবলমাত্র সামাজিক বন্ধনের তাগিদেই অনেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসে, অনেকে প্রিয় মানুষটির সাথে প্রেমের সম্পর্কের নাম এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে, লোকসমাজের গৃহীত পদ্ধতিতে এক ছাদের তলায় থাকতেও বিয়ে করে। বিয়ে করলেই যে বনিবনা হবে, তা তো না! তবে উপায়?

হিন্দুধর্মে, প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে বিয়ে এবং পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে বিশদ আলোচনা রইলেও বিচ্ছেদের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট বিধান নেই।

প্রাচীন হিন্দু সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ প্রায় অগ্রহণযোগ্য ছিল। সাধারণত, হিন্দুধর্মে স্ত্রীর উপর স্বামীর পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল এবং তাদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরিণতি ছিল সামাজিকভাবে গর্হিত। তবে, কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, যেমন ব্যাভিচার, মারধর, নির্যাতন বা অন্য কোনো গুরুতর কারণে সম্পর্ক ভাঙা হতে পারত, তবুও অফিশিয়ালি বিচ্ছেদের কোনো কানুন ছিলোনা। প্রাচীন হিন্দু সমাজে এটি সাধারণত এড়ানো হতো, তবে আধুনিক সমাজে এবং ভারতীয় আইনে কিছু শর্তে ডিভোর্সের অধিকার রয়েছে। হিন্দু বিবাহ আইন (Hindu Marriage Act, 1955) অনুযায়ী কিছু শর্ত পূরণের মাধ্যমে, যেমন দ্বিপাক্ষিক সম্মতিতে এ আইনের অধীনে ডিভোর্স সম্ভব।

বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণীত হয়নি। বর্তমানে ১৯৪৬ সালের হিন্দু বিবাহ বিধি (Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946) এবং ১৯১৩ সালের হিন্দু বিবাহ বৈধকরণ আইন (Hindu Marriage Validity Act, 1913) অনুসারে কিছু বিধান রয়েছে, তবে এগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদের কোনো সরাসরি ব্যবস্থা নেই।

একজন হিন্দু নারী যদি বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়, এবং তার সম্পর্কের অবস্থা পরিবর্তন করতে চায়, তবে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করতে পারেন। শারীরিক নির্যাতন,মানসিক নির্যাতন, বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, অবিশ্বাস, অক্ষমতা- এ কারণগুলি বৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়। খোরপোশ এবং সন্তানদের অধিকারও নজরে রাখতে হয়। কোনো হিন্দু নারী বা পুরুষ আইনি প্রক্রিয়ায় বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন না, যার ফলে অনেক নারী বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন অর্থাৎ সেপারেশনে থাকতে বাধ্য হন।
স্বামী যদি স্ত্রীকে ত্যাগ করে বা নির্যাতন করে, তাহলে স্ত্রী ভরণপোষণের দাবি করতে পারেন, কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন না।

যদিও কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় হিন্দু নারী বা পুরুষ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে বিবাহবিচ্ছেদ নথিভুক্ত করেন, কারণ মুসলিম পারিবারিক আইনে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি রয়েছে।
এটি একটি বিতর্কিত ও সামাজিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়।

ডিভোর্সের জন্য হিন্দু নারী বা পুরুষকে আদালতে মামলা দায়ের করতে হয়। বিচারক কপির স্বাক্ষরিত পিটিশনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আদালত দুই পক্ষকে শুনানির পর ডিভোর্সের আদেশ দিতে পারে। আইন অনুযায়ী, ডিভোর্সের পিটিশন ফাইল করার পর সাধারণত ৬ মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই সময়সীমা বাড়ানোও হতে পারে। কিন্তু আদতে ডিভোর্স সম্পন্ন হয়না। সেই চুড়ান্ত আইন আমাদের নেই।Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946 আইনের আওতায় সর্বোচ্চ সেপারেশন মেলে।

তাছাড়া বাংলাদেশে পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর ধারা ৬-এর আওতায় যেকোনো ধর্মাবলম্বীই বিয়েবিচ্ছেদ চাইতে পারবেন। এটি ডিভোর্স নয়, বরং দেওয়ানি আইনে বিয়েবিচ্ছেদ। কিন্তু এক্ষেত্রেও বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন সম্ভব হলে [কিংবা না হলেও (?)] আদালত দুই পক্ষকে পুনঃমিলনের জন্য আহ্বান করতে পারে। বেশিরভাগ প্রশাসনিক কর্মকর্তা অবস্থা বেগতিক দেখেও সমঝোতার পরামর্শই দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের উকিলদের মধ্যে কিছু কিছু (আসলে বেশিরভাগ) হিন্দু ডিভোর্সের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকেন এবং নেওয়ার কারণগুলো বেশ কিছু সামাজিক, ধর্মীয় এবং আইনি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত।

হিন্দু নারীদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে।
বাংলাদেশ আইন কমিশন ২০১৭ সালে “হিন্দু বিবাহ আইন সংস্কার” সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রস্তাব দেয়, যাতে বিবাহবিচ্ছেদের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল, তবে এখনো এটি কার্যকর হয়নি।

এছাড়াও হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে।

১.বাংলাদেশে অনেক হিন্দু পরিবার এবং সমাজের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পবিত্র এবং অখণ্ড মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মের মতে, বিয়েকে এক পবিত্র বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা কেবল পার্থিব জীবনে নয়, আধ্যাত্মিক ও পরলোকেও গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনেক হিন্দু আইনজীবী ডিভোর্সের বিরোধিতা করেন, কারণ তারা মনে করেন যে, এটি ধর্মীয় শিক্ষার বিরুদ্ধে যায় এবং সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ঘটাতে পারে।

২.বাংলাদেশে সাধারণভাবে ডিভোর্স একটি সামাজিক ট্যাবু, বিশেষ করে হিন্দু সমাজে। একটি ডিভোর্স হওয়া মানে পরিবারের সুনাম এবং সামাজিক মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। অনেক হিন্দু আইনজীবী বিশ্বাস করেন যে, ডিভোর্সের মাধ্যমে এই ধরনের সামাজিক স্টিগমা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে।

৩. ১৯৪৬ সালের হিন্দু বিবাহ বিধি (Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946) অনুযায়ী হিন্দুদের সেপারেশনের প্রক্রিয়াও কিছুটা জটিল। অনেক আইনজীবী মনে করেন যে, ডিভোর্সের ক্ষেত্রে উক্ত আইনে কিছু আইনগত অস্পষ্টতা এবং খোলামেলা শর্তের অভাব রয়েছে, যা আইনি প্রক্রিয়া আরও জটিল করে তোলে। এছাড়া, ডিভোর্সের ক্ষেত্রে আদালতের রায় বা সিদ্ধান্তে কিছু সময়ের জন্য স্থগিতাদেশ বা বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রে পুরনো আইনের সংস্কারের অভাবে পরিস্কার হতে পারে না। এজন্যই সেপারেশনের রায় পেতেও দেরি হয়।

৪.অনেক হিন্দু আইনজীবী এবং সমাজের লোকেরা মনে করেন যে, ডিভোর্স একটি শেষ বিকল্প হওয়া উচিত। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা বা পুনর্মিলনের জন্য চেষ্টা করতে চান। তাদের মতে, ডিভোর্স হলে সমাজে তা একটি নেগেটিভ সিগন্যাল দিতে পারে এবং পুনরায় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

৫.হিন্দুদের ডিভোর্সের ক্ষেত্রে আইনজীবী এবং বিচারকদের মধ্যে মাঝে মাঝে একটি সংবেদনশীলতা দেখা দেয়, কারণ এটি কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয় নয়, বরং সামাজিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে, অনেক আইনজীবী মনে করেন যে ডিভোর্স কেবল আইনি প্রক্রিয়া হিসেবে না দেখে, এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

৬. বাংলাদেশে অনেক পুরনো প্রথা এবং রীতির প্রচলন রয়েছে, যেখানে বিয়ে এবং সম্পর্কের বিচ্ছেদ সাধারণভাবে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। এক্ষেত্রে, কিছু আইনজীবী মনে করেন যে, ডিভোর্সের পক্ষে দাঁড়িয়ে তারা এই পুরনো সামাজিক প্রথাগুলিকে ভেঙে ফেলছেন, যা কিছুটা সঙ্কটময় হতে পারে। এছাড়াও অনেক সনাতন মানুষ এখনো মনে করেন যে হিন্দু সম্প্রদায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ বলতে কিছু নেই।

হিন্দু ধর্মের মধ্যে বিয়ে একটি পবিত্র সম্পর্ক হিসেবে বিবেচিত হওয়ায়, অনেক আইনজীবী একে সহজে ভাঙার পক্ষে নন। তবে, আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে, হিন্দু বিবাহ আইনে ডিভোর্স একটি অবৈধ আইনি প্রক্রিয়া, হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946 অনুযায়ী শুধু সেপারেশন সম্ভব যা নির্দিষ্ট শর্তে এবং সঠিক আইনি পদ্ধতির মাধ্যমে সম্ভব। তবে সমাজের স্যুটেড-বুটেড উচ্চমার্গীয় সো-কল্ড স্কলারদের কারণে ইসলামের তুলনায় হিন্দু ডিভোর্স ভীষণই জটিল এবং নেক্সট টু ইম্পসিবল প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। এজন্যই হিন্দুদের বেশিরভাগ সময় ডিভোর্সের জন্য অন্যান্য আইনের সহায়তা নিতে হয়; ভাগ্য সহায় থাকলে ডিভোর্স মেলে নাহলে সেই সেপারেটেড বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হয়। এ কারণেই অনেক দম্পতি বনিবনা না হওয়া সত্ত্বেও মুখ বুজে সংসার করে যায়। সমাজের এ প্র‍্যাক্টিসটি বন্ধ না হলে এভাবেই মানুষ অনিচ্ছায় সাত পাকে বেঁধে থাকতে বাধ্য হবে!

রেফারেন্স: http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-214.html