ইসমাম জামান
ইদানিং কালে বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় “পাশের বাসার জাজমেন্টাল আন্টি” এক চরম হাস্যরসের নাম। গুলশানের এলিট সম্প্রদায় থেকে শুরু করে মফস্বলের টিনেজ বালিকাও এই চরিত্রের সঙ্গে সহজেই রিলেট করতে পারে। এই “পাশের বাসার আন্টিরা” বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের গায়ের রঙ নিয়ে মন্তব্য করেন, বর কেমন, কত লম্বা বা কী চাকরি করে, বিয়েতে কী ধরনের মাংস পরিবেশন করা হয়েছে এসব নিয়ে গভীর গবেষণায় মগ্ন থাকেন। রাস্তায় অচেনা মেয়েদের পোশাক, ওড়না এসব নিয়ে তাদের চিন্তার যেন শেষ নেই। এদের জীবন যেন “নিজের” থেকে বেশি “অন্যদের” জীবন নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য নিবেদিত।
এই আচরণগুলো আমাদের অনেকেরই পরিচিত। তবে, যদি আমরা এই আচরণগুলোর মধ্যে একটু গভীরভাবে মনোযোগ দিই, তাহলে বুঝতে পারব যে, এগুলো আমাদের সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতার যে গোঁড়া সংস্কৃতি তারই ফলশ্রুতি। এটা এমন এক কাঠামো যেখানে নারীদের মধ্যে একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করা হয়। তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটা যতটা না নারীদের দায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পুরুষতন্ত্রের ধূর্ত কৌশল।
যেমন, একজন অত্যাচারী শ্বাশুড়ি কোনোদিনই অত্যাচারী হয়ে জন্ম নেয়নি। সে নিজে একদিন অন্যের বাড়ির বউ হয়ে এসেছিল সব কিছু ছেড়ে। সেই সময় তার প্রয়োজন ছিল এক নিরাপদ আশ্রয়, মাতৃস্নেহ এবং একটি পরিবারে নিজের স্থান। কিন্তু উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে, কতজন মেয়ে এমন সহায়ক পরিবেশ পায়? বিয়ের পর, আমরা ‘বউ’ পরিচয়ে এত বেশি মশগুল থাকি যে, তার ব্যক্তি পরিচয়, নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া, ভালো লাগা, মন্দ লাগা—এসব কিছুই ভুলে যাই।
পাশের বাসার আন্টিরা যেভাবে নারী স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত চয়েস নিয়ে কথা বলেন, তা আসলে পুরুষতন্ত্রের চাপের এক নিঃসঙ্গ কণ্ঠস্বর। এক্ষেত্রে, পুরুষতন্ত্র সমাজে প্রথাগত মূল্যবোধ ও কনজার্ভেটিভ চিন্তাধারা রক্ষা করতে “পাশের বাসার আন্টিদের” ব্যবহার করে। এই মাধ্যমে নারীরা নিজেদের অজান্তেই নিজেদের মধ্যে একে অপরকে শত্রু ভাবতে শিখে, যে কারণে পুরুষতন্ত্র আরও শক্তিশালী হয়। প্রচারিত হয় ‘নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু নারী’-এর মতো ইন্টার্নালাইজড মিসোজিনিস্টিক তত্ত্ব।
একদিন যে বউ ছিল, সে আজ হয়ে উঠেছে এক অত্যাচারী শ্বাশুড়ি, পাশের বাসার আন্টি—পুরুষতন্ত্রের তৈরি এক পণ্য। দুঃখজনক বিষয় হলো, এই নারীর যন্ত্রণার গল্প কখনোই সমাজ ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করেনা, তাকে শুধু নিন্দা করা হয়, যা নারীবিদ্বেষের পথ প্রশস্ত করে দেয়। সমাজে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে, এভাবেই “আন্টি সম্প্রদায়” তৈরি করা হয়, যারা নারীদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পুরুষতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। আর আমরাও না বুঝে ভিক্টিমকে দোষারোপ করে যাই; যেখানে আমাদের উচিত আরো দৃঢ় ভাবে এই কলুষিত সিস্টেমটাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা।
