সাদমান আহমেদ সিয়াম
বঙ্গদেশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভেতরে আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসও অবধারিতভাবেই কিছুটা পুরুষতান্ত্রিক হয়েই পড়ে। নারীদের শুধু সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদী শাসনের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হয়নি, হয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধেও। কমিউনিস্ট নেতা ও তাত্ত্বিক মাও সেতুং তার বিখ্যাত প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, চীনা পুরুষের উপর কার্যকর রয়েছে তিনটি পাহাড় – সামন্ততন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ এবং আমলাতন্ত্র। নারীদের উপর কার্যকর রয়েছে চারটি – চতুর্থটি পুরুষতন্ত্র।
কিন্তু বাংলার লড়াকু ইতিহাসে নারীরা রয়েছেন, প্রবলভাবেই। তাদের সমসাময়িক সমাজের পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইও তারা করেছেন, এখনো লড়ছেন ইতিহাসের পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। তারই একজন উজ্জ্বল উদাহরণ ইলা মিত্র।
ইলা সেন ১৯২৫ সালের ১৮ই অক্টোবর ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি একাউন্টেন্ট জেনারেল। মা মনোরমা সেন ছিলেন গৃহিণী। ১৯৪৫ সালে তিনি বাংলার ইতিহাসের প্রথম মহিলা কলেজ, বেথুন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন।
কৈশোরে তুখোড় ক্রীড়াবিদ ছিলেন ইলা সেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন রাজ্যের জুনিয়র অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল এবং ব্যাডমিন্টন খেলায় ছিলেন পারদর্শী। প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক গেমসের জন্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানি হিটলার বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেজন্য বাতিল ঘোষিত হয় ১৯৪০ সালের এই অলিম্পিক। তাই ইলা সেনের আর অংশগ্রহণ করা হয়নি।
কলেজপড়ুয়া ইলা সেন যুক্ত হলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও। ১৯৪৩ সালে কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলেন তিনি। সঙ্গে যুক্ত হলেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সঙ্গেও। এটি ছিলো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত একটি গণসংগঠন। সংগঠনটি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চলমান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো। এভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ইলা সেন।
১৯৪৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার রামচন্দ্রপুর জমিদারপুত্র রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে ইলা সেনের বিবাহ হয়, ও তিনি ইলা মিত্র নামগ্রহণ করেন। রমেন্দ্রনাথ মিত্র নিজেও ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য। তৎকালীন সামাজিক রক্ষণশীলতার ভিতরে ইলা মিত্র কিছুটা আটকেই গিয়েছিলেন। কিন্তু দ্রুতই তার জীবনে এলো নতুন সংগ্রাম। রমেন্দ্রনাথ মিত্র, বন্ধু আলতাফ মিয়ার তত্ত্বাবধানে কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাটে একটি স্কুল খোলেন, মেয়েদের জন্য। তিনজন ছাত্রী নিয়ে শুরু হওয়া সেই স্কুলে শিক্ষিকার দায়িত্ব নিলেন ইলা মিত্র। তিনমাসের মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা হলো পঞ্চাশজন। প্রথমের দিকে গরুর গাড়ি চড়ে যেতে হতো তাকে, সম্ভ্রান্ত বাড়ির বউ কিনা! কিন্তু তিনি হেঁটেই স্কুলে যাওয়ার অনুমতিটাও নিয়ে নেন। এভাবেই সামাজিক বৃহত্তর স্বার্থে তার লড়াই শুরু।
এরপর আসে ইলা মিত্রের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় আত্মত্যাগ – তেভাগা আন্দোলন। সেই ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে চাষের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদারদের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে বীজবপন থেকে শুরু করে ফসল ফলানো পর্যন্ত সম্পূর্ণ কায়িক এবং মানসিক শ্রম দেবার পরও চাষীর জুটত মোট ফসলের তিনভাগের একভাগ। ১৯৩৬ সালে “লাঙ্গল যার জমি তার” এই স্লোগান নিয়ে তৈরি হয় ‘নিখিল ভারত কৃষক সভা’। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা প্রস্তাব করে ‘ফ্লাউড কমিশন’ এর। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ এবং ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ দেয়ার দাবি উঠে।
১৯৪২ সালে সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় চরম দুর্ভিক্ষ, যাকে এর বঙ্গসাল ১৩৫০ এর কারণে পঞ্চাশের মন্বন্তর বলা হয়। ব্রিটিশ রাজের যুদ্ধের চাহিদা যোগান এবং জমিদারদের অত্যাচারে কৃষকরা মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধারণা করা হয়, অন্তত ২১ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ এই মন্বন্তরে মারা যায়। অনেকে সর্বস্বান্ত হন। এই পরিস্থিতিতেই দানা বেঁধে ওঠে তেভাগা আন্দোলন।
ইলা মিত্র এই আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবেই জড়িয়ে পড়েন। তার নেতৃত্বে নাচোল হয়ে ওঠে আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ১৯৪৬ সালে দেশভাগের পূর্ববর্তী সময়ের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা প্রতিরোধ করেন তারা। এখানে সামনের সারিতে ছিল সাঁওতালরা। গুরুত্বপূর্ণ এই যে, একজন বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার আদিবাসী কৃষকদের মধ্যে ইলা মিত্রের গ্রহণযোগ্যতা। তাকে তারা নিজেদের একজন বলেই ভাবতেন। ১৯৪৬-৪৭ সালের তেভাগা আন্দোলনের এই প্রথম ধাপেই নেত্রী হিসেবে স্থায়ী আসন করে নেন ইলা মিত্র।
দেশভাগের পরবর্তী সময়ে, আবার জেগে ওঠে তেভাগা আন্দোলন। তবে এইবার আরো কড়াকড়ি। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। ইলা মিত্র এবং স্বামী রমেন্দ্র মিত্র তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের গ্রামে আত্মগোপন। একে তাদের ধর্মীয় পরিচয়, তার ওপর তাদের রাজনৈতিক পরিচয় – দুইয়ে মিলে তারা হয়ে পড়েন শাসকযন্ত্রের লক্ষ্যবস্তু।
এসবকিছুকে মেনে নিয়েই ইলা মিত্র আবার শুরু করেন তার কার্যক্রম। এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। অনেকগুলো গ্রাম তখন দখলে নেয়া হয়, যেখানে এই দুই-তৃতীয়াংশ ফসল দেবার রীতি চালু হয়। কোন কোন সময় তা জোর ছাড়াই, কোন কোন সময় জোরপূর্বক। ১৯৪৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে কৃষকের ধান জোতদারদের কাছে না দিয়ে সরাসরি কৃষক সমিতির উঠোনে তোলা হয়। সংঘর্ষ বাঁধে জমিদার-জোতদারদের মদদে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং কৃষকদের মধ্যে। সাঁওতাল এবং ভূমিহীন কৃষকেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তীর ও লাঠির সহযোগিতায়। যার প্রধান ছিলেন মাতলা মাঝি নামের একজন সাঁওতাল।
এরপর তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার এই আন্দোলন দমনে দুই হাজার সেনা পাঠায়। তখন তারা গ্রামে শুরু করে তাণ্ডব। বাড়িঘর জ্বালানো এবং হত্যার মাধ্যমে তারা কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে ইলা মিত্র তখন ১ নম্বর আসামী, তার সঙ্গে আরো ২৩ জন।
ইলা মিত্র সাঁওতালদের পোশাক পরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু রহনপুরে তিনি গ্রেফতার হয়ে পড়েন। তাকে নাচোল থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার উপর চলে পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতনের চূড়ান্ত, যা যে কাউকেই দুর্বল করতে বাধ্য। প্রথমে নাচোল থানায় নির্যাতনের পর জ্বরগ্রস্ত ও রক্তাক্ত ইলা মিত্রকে পাঠানো হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ হাসপাতাল। সেখান থেকে আবার রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার। এখানে রাজশাহী আদালতে প্রদত্ত ইলা মিত্রের ঐতিহাসিক জবানবন্দি বিখ্যাত, এজন্য হুবহু তুলে ধরাটাই সমীচীন।
“কেসটির ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। বিগত ০৭/০১/১৯৫০ তারিখে আমি রহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোল নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধর করে এবং তারপর আমাকে একটা সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ হত্যাকা-ের সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার না করলে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে বলে এস আই আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলার মত কিছু ছিল না, কাজেই তারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপর খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দী করে রাখে। আমাকে কোন খাবার দেয়া হয়নি, এক বিন্দু জলও নয়। সেদিন সন্ধ্যা বেলাতে এস আইয়ের উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত শুরু করে।…তারা অমানুষিক নির্যাতন চালায়। সেলে চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিল। তারপর চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিৎ করে শুইয়ে দেয় এবং একজন আমার যৌনাঙ্গের ভিতর একটা ডিম ঢুকিয়ে দিল। আমি আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম। এর পর অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ৯ জানুয়ারি ১৯৫০ সকালে যখন আমার জ্ঞান হলো তখন উপরোক্ত এস আই এবং কয়েকজন সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুট দিয়ে আমাকে চেপে লাথি মারতে শুরু করল। এর পর আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হলো। সেই সময় আধাচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এস আইকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না কর তাহলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে এস আই এবং সেপাইরা ফিরে এলো এবং তারা আবার সেই হুমকি দিল। কিন্তু যেহেতু তখনো কিছু বলতে রাজি হলাম না তখন তিন-চারজন আমাকে ধরে রাখল এবং একজন সেপাই সত্যি সত্যি ধর্ষণ করতে শুরু করল। এর অল্পক্ষণ পরই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। পরদিন ১০ জানুয়ারি যখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো তখন আমি দেখলাম যে, আমার দেহ থেকে দারুণভাবে রক্ত ঝরছে এবং কাপড়-চোপড় রক্তে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। এর পর আমাকে নবাবগঞ্জ হাসপাতালে পাঠানো হলো এবং ২১ জানুয়ারি নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানকার জেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।… কোন অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি।”
এই নারকীয় অত্যাচারের পর ইলা মিত্রকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এমতাবস্থায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানিসহ কয়েকজন নেতা সরকারকে অনুরোধ করেন শর্তহীনভাবে ইলা মিত্রকে মুক্তি দিতে, অন্যথায় তাকে বাঁচানো যাবে না। সরকারি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে ইলা মিত্র কলকাতায় যান। তার আর পৈত্রিক ভূমিতে ফেরত আসা হয়নি।
বিভীষিকাময় এই ঘটনার পর ইলা মিত্র পরবর্তীতে কলকাতায় আবার রাজনীতি করেছিলেন। তিনি ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত চারবার পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দুঃখজনক হলেও, সেখানেও তিনি কয়েকবার জেলবন্দি হয়েছেন তার মুক্তিমুখীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য। ছিলেন কলকাতা সিটি কলেজের অধ্যাপিকাও, তার প্রথম জীবনের শিক্ষিকাজীবনের পরিপূর্ণতা দিয়ে। ২০০২ সালের ১৩ই অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং সচেতন ছিলেন তিনি।
তার কর্মকাণ্ড ও স্পৃহা সেসময় শাসকদের বুকের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ধরিয়ে তো দিয়েছিলোই। নতুবা একজন নেত্রীকে দমন করার জন্য এতখানি বীভৎস অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়? ইলা মিত্র ছিলেন নাচোলের মানুষদের কথা অনুযায়ী – রাণীমা। তার রাজনীতি এবং কাজ মানুষের পক্ষে ছিলো দেখেই শোষণমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে বাধা পেয়েছেন বারবার।
মৃত্যুর পরেও সে-অর্থে স্মরণ করা হয় না তাকে, যেমন স্মরণ করা হয় না খোদ তেভাগা আন্দোলনকেও। এরমধ্যে যেমন আছে লৈঙ্গিক অবদমনের চেষ্টা, তেমনি আছে আদিবাসী কৃষকশ্রেণির ইতিহাসকে অবদমনের চেষ্টাও। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, কোন সংগ্রামই একরৈখিক নয়, একমাত্রিক নয়। তাই ইলা মিত্র এবং তার তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিকে জাগরুক রাখতে হবে আমাদেরকেই।
ইলা মিত্রের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
