লিখেছেন: সাদমান আহমেদ সিয়াম
বাংলাদেশ শুধু বাঙালিদের দেশ নয়। এই দেশে আরো অনেক জাতিগোষ্ঠী বসবাস করেন। এই আদিবাসীরাও বাংলাদেশের অংশ, বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। অন্তত, এমনটাই হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই জনগোষ্ঠী এবং তাদের নিজস্ব লড়াই-সংগ্রামকে জনপ্রিয় ইতিহাসের মধ্যে তুলে আনার চেষ্টা খুবই কম। এর পেছনে জাতিগত আধিপত্যবাদের একটা ধারণা কাজ করে।
এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রচলিত সংবিধানের প্রথম ভাগের ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে লিখিত আছে যে, “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” এই বাক্য, যার বিরুদ্ধে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তা স্পষ্টই সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে অন্যান্য জাতিসত্তাসমূহকে অস্বীকার করে। এই আধিপত্যবাদ বিভিন্নভাবে আদিবাসীদের পিছিয়ে রেখেছে – শিক্ষাদীক্ষা বা কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে তো অবশ্যই, পিছিয়ে রেখেছে আছে তারা নিজেদের ইতিহাসকে তুলে ধরার ক্ষেত্রেও। আর অন্যদিকে, নারীসত্ত্বাকে অবদমিত করার দিক দিয়ে পুরুষতন্ত্রের জুড়ি নেই। তাই আদিবাসী নারীদের এই দুই ধরনের কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার মধ্যেই টিকে থাকতে হয়। টিকিয়ে রাখতে হয় তাদের গল্পগুলি, তাদের ইতিহাস।
তেমনি একজন বিদ্রোহী রাশিমণি হাজং – টংক আন্দোলনের সময় যিনি চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছিলেন তার শোষকদের সঙ্গে। গল্পের ভেতরে ঢুকতে গেলেই দেখা যাবে অনেকগুলি প্রশ্ন হাজির হচ্ছে – জাতিসত্তার প্রশ্ন, লিঙ্গপ্রশ্ন, এবং তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই জ্বালাতন করতে আসবে শ্রেণিপ্রশ্ন।
বঙ্গদেশে যদি কোন শ্রেণির কথা চিন্তা করা হয় যাদের জীবনের সত্যিকার অর্থে অপরিবর্তিত রয়েছে – তারা হলেন বাংলার আদি উৎপাদকগোষ্ঠী, বাংলার কৃষক। অবাক হয়ে ভাবতে হয় যে যাদের কাজের উপর ভিত্তি করে মানুষ এতখানি নির্ভর করে, ঠিক তাদেরই উপর কিভাবে এতখানি শোষণ কিভাবে করা হয়েছে। ব্রিটিশদের পূর্বেও কৃষকদের উপর নিপীড়ন ছিলো। ব্রিটিশরা আসার পর বিভিন্ন বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদের ক্ষমতাবৃদ্ধি করে আর কৃষকদের নির্যাতনের পথ করে প্রশস্ত। তারই একটা অংশ ছিলো টংক প্রথা।
টংক প্রথা মূলত জমিতে উৎপাদিত পণ্যের জন্য জমিদারকে প্রদেয় খাজনাকে বোঝায়। এই টংক জমির উপর কৃষকদের কোনপ্রকার অধিকার ছিলো না। ব্রিটিশ ভারতে ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে কলমাকান্দা, সুসং দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবদীসহ সুসং জমিদারি এলাকায় এই প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। এই অঞ্চলের অধিবাসী মূলত গারো এবং হাজং সম্প্রদায়। এই প্রথায় সোয়া একরে খাজনা ছিল ৭ থেকে ১৫ মণ ধান। অন্যদিকে সাধারণ কৃষকদের খাজনা ছিল ৫ থেকে ৭ টাকা। প্রতিমণ ধানের দাম সোয়া দুই টাকা হিসেবে প্রায় ১১ থেকে ১৭ টাকা অতিরিক্ত খাজনা দিতে হতো। অর্থাৎ, টংক এলাকার ভেতরে যেই কৃষকরা কাজ করছিলেন, তাদের অন্য এলাকার কৃষকদের থেকে প্রায় দ্বিগুণের বেশি খাজনা দিতে হচ্ছিলো! এই জমিদারদেরকে যখন বলা হলো অন্যান্য এলাকার মতোই টাকায় খাজনা নিতে, তারা রাজি হলেন না। নির্মম এই শোষণের বিরুদ্ধেই ধীরে ধীরে গঠিত হয় টংক আন্দোলন।
কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ মণি সিংহের নেতৃত্বে একত্রিত হয় কৃষকেরা। ১৯৩৭ সালে এই আন্দোলনের সূচনা হয় টংক প্রথার বিলুপ্তি, টংক কৃষকদের ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি এবং জমিদারি প্রথার বিলুপ্তিসহ মোট ছয় দফা দাবিসহ। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনের উপর ব্রিটিশরা তীব্র বলপ্রয়োগ করে।
রাশিমণি হাজং ১৮৯৭ সালে জন্মেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার সুমঙ্গ পরগণার ভেদিপুরা অঞ্চলের বগাবারী গ্রামের এক গরিব হাজং পরিবারে। ১২ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়, যার অনতিকাল পরেই তিনি বিধবা হন। এজন্য তাকে গ্রামবাসী ‘ডাইনি’ বলে ডাকত। বিধবা রাশিমণি বিভিন্ন কিছু করতেন – অন্যের জমিতে ধান লাগানো, ধান কাটা, কখনোবা চাল তৈরি করে বিক্রি বা কাঠ বিক্রি। পরবর্তীতে সামাজিক চাপে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তার স্বামী ছিলেন একজন কবিরাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে তিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী গণসংগ্রামের সময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিতে যোগ দেন। এই সমিতির হয়ে তিনি ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় খাদ্য সরবরাহের তদারকি করতেন। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, তার নেতৃত্বে হাজং চাষীরা ব্যবসায়ী মজুতদারদের গোপন খাদ্যের গুদাম বের করে সেই খাদ্য ছিনিয়ে আনতেন! হাজং চাষীদের অশিক্ষা এবং সেই থেকে সৃষ্ট সমস্যার কথা বুঝে তিনি একটা নৈশ বয়স্ক বিদ্যালয় খোলার উদ্যোগ নেন। এভাবে তিনি হয়ে ওঠেন ময়মনসিংহের সীমান্ত আর পার্বত্য অঞ্চলের নারী নেত্রী।

১৯৩৭ সালে টংক আন্দোলন শুরু হবার পরেই তিনি নিজেকে এর সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি তার সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে নারীদেরকে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি এবং আরেকজন অবিস্মরণীয় নেত্রী কুমুদিনী হাজং মিলিতভাবে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব হিসেবে কাজ করেন। এই সমগ্র নারী সমাজ এই টংক আন্দোলনে বিপুল অবদান রেখেছিলো বিভিন্নভাবে। শুধু পেছনে থেকে আন্দোলনের কর্মীদের আশ্রয় দেওয়াই শুধু নয়, একদম সামনে থেকে ব্রিটিশ লাঠিয়াল বাহিনীর চোখে চোখ রেখে তারা আন্দোলন করে গিয়েছেন।
১৯৪৬ সালের ৩১শে জানুয়ারি পুলিশ বিরিশিরিতে নিজেদের ক্যাম্প স্থাপন করে এবং আন্দোলন দমানোর জন্য হাজং গ্রামগুলিতে আক্রমণ করে। তারা গ্রামবাসীদের উপর কিছু ক্ষেত্রে গুলি চালায় এবং অনেক ক্ষেত্রে হয়রানি করে। পরবর্তীতে রাশিমণির নেতৃত্বে নারীরা দা নিয়ে বেরিয়ে এসে পুলিশদের তাড়া করলে তারা পালিয়ে যায়। ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস নামক সশস্ত্র বাহিনী আবার পরবর্তীতে আসে আন্দোলনের আরেক নেত্রী কুমুদিনী হাজং এর স্বামী এবং তিন ভাইকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তারা না থাকায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস কুমুদিনী হাজংকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।
এই ঘটনায় প্রথমে হাজং নারী-পুরুষরা তাদের পথরোধ করে এবং কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিতে বলে। তাতে কর্ণপাত না করে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস এগিয়ে যেতে থাকে। তখন রাশিমণি হাজং এবং তার সাথে দিস্তামণি হাজং, বাসন্তী হাজংসহ ১২ জনের সশস্ত্র মহিলা দল দা-কাস্তে-কুড়াল নিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস তাকে সরাসরি গুলি করে। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে ধরতে গেলে পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজংকেও নির্দয়ভাবে গুলি করা হয়। এরপর উপস্থিত জনতা ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওখানে দুইজন পুলিশ মারা যান। বাকিরা পালিয়ে যান।
তার আত্মত্যাগ টংক আন্দোলনকে গতি দান করে। এই জন্য হাজংদের কাছে এই নিঃসন্তান রাশিমণির উপাধি হয় হাজংমাতা। তার স্মরণে ২০০৪ সালে নির্মিত হয় শহীদ হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ এবং পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হলে এই নির্মম টংক প্রথা বিলুপ্তি হয়।
পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, নিম্নশ্রেণি তথা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং তীব্র বলপ্রয়োগের ইতিহাস নতুন নয়, বরং এটি ঔপনিবেশিক আমলের চিহ্ন। সেই একই পুলিশি রাষ্ট্র এখনো গার্মেন্টসশ্রমিক, কাকতালীয়ভাবে যার একটি বৃহৎ সংখ্যক নারী, তাদের উপর একইভাবে গুলিবর্ষণ করে। একইভাবে তাদের প্রাণহরণ করে। তারা পায় না বিচার, পায় না তাদের ন্যায্য মজুরিটাও। আবার, যদি নারী বাঙালি না হয়ে হয় আদিবাসী তখন সেই চাওয়া হয়ে ওঠে আরো দুষ্কর। তাদের প্রাণ আরো নিম্নমর্যাদার হিসেবে প্রদর্শিত হয়।
ইতিহাসে কেন উঠে আসে না রাশিমণি হাজং এর গল্প? একদিকে শ্রমিক-কৃষকশ্রেণির সংগ্রামকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা, অন্যদিকে বাঙালি জাতিবাদে অন্যান্য জাতির সংগ্রামকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা। এই প্রবণতা থেকে বের না হতেই হবে। স্মরণে রাখতে হবে আমাদের অন্নদাতা কৃষকশ্রেণির গল্পগুলি, মনে রাখতে হবে আমাদের প্রত্যেক জাতিসত্তার সংগ্রামের কাহিনী। না হলে আমাদের ইতিহাস হয়ে থাকবে একপাক্ষিক-একরৈখিক। আমাদের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর মতোই আমাদের সংগ্রাম – সেই ইতিহাস আমরা হারিয়ে ফেলবো।
