২০ এপ্রিল ২০২৫
বিষয়: মেঘনা আলমকে অবৈধভাবে আটক করে, মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন ও আদালতের অবমাননা করার বিষয়ে উদ্বেগ, এবং ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি।
মহোদয়,
আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে এই চিঠি প্রেরণ করছি, যা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে—বাংলাদেশের নাগরিক মেঘনা আলম কে ৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগএবং ভাটারা থানার কর্মকর্তারা তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন ও আদালতের নির্দেশ অবমাননা করে আটক করে।
এই ঘটনাটি সামনে আসে মেঘনা আলমের নিজের আটক হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তের ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে, বুধবার ৯ এপ্রিলে সূর্যাস্তের পর, যেখানে দেখা যায় অস্ত্রে সজ্জিত একদল পুরুষ জন্ম নিবন্ধন যাচাইয়ের নাম করে তার বাসায় জোর পূর্বক ঢোকার চেষ্টা করছে। মেঘনা দরজা খুলতে অস্বীকার করলে তারা দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করে, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই তার ডিভাইসগুলো ছিনিয়ে নেয় এবং কোনো কারণ না জানিয়ে, তাদের পূর্ণ পরিচয় না দিয়ে, তাকে কোথায় এবং কেন নিচ্ছে না জানিয়ে, তাকে আটক করে।
লাইভটি দেখে সাথে সাথেই কয়েকজন নারী অধিকার কর্মী সরেজমিনে তদন্ত করতে ঘটনাস্থলে যায় এবং জানতে পারে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তা মেঘনা আলমকে আটকের জন্য মোতায়েন হয়। তারা বাড়িওয়ালা, পাড়া প্রতিবেশী কাউকে নিজেদের আইডি না দেখিয়ে উল্টো হুমকি ধামকি দিয়ে মেঘনা আলমকে আটক করে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে তারা এমনকি বিল্ডিংটির সিসিটিভি হার্ডড্রাইভ পর্যন্ত নিয়ে যায়।
৯ এপ্রিল রাতে ভাটারা থানা জানায় মেঘনা আলম ডিবির হেফাজতে আছেন এবং তারা কোন মেঘনার আটকের ব্য়াপারে জিডি করতে রাজি না। ডিবি অফিসে গেলে তারা মেঘনাকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে, নারীবাদী দলটির ধারাবাহিক অনুসন্ধানের পরও ডিবি কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো দায়সারা ভাবে ওয়েবসাইট থেকে ফোন নম্বর যোগাড় করে কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন| কিন্তু ফোন করলে সেই ফোন নম্বরগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।
প্রায় ২৪ ঘণ্টার অনিশ্চয়তার পর, ১০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে, সামাজিক ও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায় মেঘনা আলমকে ঐদিন রাত ১০:৩০ টায় আদালতে তোলা হয় এবং “জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি”, “কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করা” এবং “দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির ষড়যন্ত্র” করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী ৩০ দিনের জন্য কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সামাজিক ও সংবাদমাধ্যম সূত্রে ডিএমপির দেয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে যে মেঘনা আলম “নিরাপদ হেফাজতে” আছেন – অথচ শুধুমাত্র নারী নির্যাতনের মামলা ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে হেফাজতের আবেদন না করে, তাহলে আইন অনুযায়ী এমন হেফাজতের সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার ও নাগরিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমের দৃষ্টির কারণে, ১৩ এপ্রিল রোববার হাইকোর্ট এর একটি ডিভিশন বেঞ্চ একটি রুল জারি করে সরকারের কাছে দুই সপ্তাহের মধ্য়ে জানতে চান কেন মেঘনা আলমের আটকের প্রক্রিয়াকে এবং তার ওপর বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে আটকাদেশ জারি করা অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এবং কেন তাকে মুক্তি দেয়া হবে না । কিন্তু এরই কয়দিন পরে ১৭ এপ্রিল, মেঘনা আলমকে ধানমণ্ডি থানায় দায়েরকৃত একটি নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে আমরা গণমাধ্য়ম থেকে জানতে পারি, যেখানে তাকে চাঁদাবাজি ও প্রতারণায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই সময়ে মেঘনা আলমের পরিবার ও আইনজীবি উপস্থিত ছিলেন না এবং তাদেরকে উপস্থিত থাকারও কোন সুযোগ দেয়া হয়নি।
উল্লেখ্য়, মেঘনা আলমের সাথে তার পরিবার সাত দিন পরে দেখা করার সুযোগ পান – যেহেতু এই আইনে সাক্ষাতের ওপর জোর রেস্ট্রিকশন দেয়া আছে – স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন ছাড়া দেখা করা যায় না। ইতিমধ্য়ে মেঘনার ছোট বোনেরা টেলিফোনে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্য়মে নানা রকম হুমকি পেয়ে যাচ্ছে।
এই ঘটনাগুলো গুরুতর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন ও আদালতের অবমাননার উদ্বেগের সৃষ্টি করে, বিশেষ করে নিম্নলিখিত দিকগুলোতে:
● বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৩ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন, যা যথাযথ প্রক্রিয়া, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করে;
● বাংলাদেশ ও অন্যান্য বনাম ব্লাস্ট ও অন্য়ান্য় (69 DLR (AD) (2017) 63 মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দিক নির্দেশনার অবমাননা, যা নির্বিচারে গ্রেফতার নিষিদ্ধ করেছে এবং বিনা পরোয়ানার গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কঠোর প্রক্রিয়া নির্ধারণ করেছে;
● আওয়ামী লীগের সরকার আমলের কঠোর এবং বিতর্কিত আইন “বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪”-এর অপব্যবহার, যা মতপ্রকাশ দমন ও বিরোধীদের নিপীড়নে ব্যবহৃত হয়েছে;
আমরা অবিলম্বে সরকারের কাছ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করছি:
● প্রথমে আটক তারপর গ্রেফতার দেখানোর জুলুমবাজি প্রক্রিয়া কেন অনুসরণ করা হল;
● কে এই আটকের নির্দেশ দিয়েছে;
● কেন ৩০ জন কর্মকর্তা একজন নারীর আটকের মোতায়েন করা হলো, যখন সারা দেশেই নিরাপত্তাহীনতা বিদ্যমান;
● কী তদন্তের ভিত্তিতে তাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে;
● আটকের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে কিনা;
● হেফাজতে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে;
● এসব ঘটনা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে কিনা।
আমাদের দাবি:
১. অবিলম্বে মেঘনা আলমের মুক্তি।
২. তাকে কারা এবং কেন এইভাবে আটক করলো সেটা নিয়ে দ্রুত এবং স্বচ্ছ, স্বতন্ত্র তদন্ত, এবং তার প্রেক্ষিতে দায়ী ব্যাক্তিদের চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই এই বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, আমাদের আদালতে এবং আন্তর্জাতিক/ জাতি সঙ্ঘের মানবধিকার প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রয়োজনীয় আইনগত অভিযোগ দাখিলের অধিকার আমরা সংরক্ষণ করি।
বিনীত,
১. ব্যারিস্টার তাবাসসুম মেহেনাজ, মানবাধিকার আইনজীবী ও অধিকারকর্মী
২. ইশরাত জাহান প্রাচী, মানবাধিকার আইনজীবী ও অধিকারকর্মী
৩. পারসা সানজানা সাজিদ, লেখক ও গবেষক
৪. নাসরিন সিরাজ, নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
৫. মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্য়াপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্য়ালয়
৬. মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৭. নাজনীন শিফা, শিক্ষক, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
৮. জিনাত আরা হক, প্রধান নির্বাহী, আমরাই পারি জোট
৯. সায়দিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক
১০. ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীত শিল্পী ও গীতিকার
১১. আমিনা সুলতানা সোনিয়া, অ্যাকটিভিস্ট ও উন্নয়নকর্মী
১২. আয়লা আমিন, শিল্পী
১৩. সৈয়দা নূর-ই-রায়হান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্ট্রাক্টর
১৪. অধরা মাধুরী, গবেষক
১৫. আদিবা রাইসা, উন্নয়নকর্মী
১৬. পদ্মিনী চাকমা, আলোকচিত্রী
১৭. নাজিফা তাসনিম খানম তিশা, থিয়েটারকর্মী
১৮. অরুণিমা তাহসিন ,গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট
১৯. সুমি আঞ্জুমান, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট
২০. কাব্য কৃত্তিকা, গবেষক ও শিক্ষক
২১. শাহেলা আক্তার উমামা, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট
২২. ওয়াসিমা ফারজানা, এসপায়ারিং এন্থ্রোপলজিস্ট ও সোশাল একটিভিস্ট
২৩. দিলশাদ সিদ্দিকা, গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী
২৪. সেঁজুতি মাকসুরাত,প্রভাষক ,ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
২৫. আনতারা ফারনাজ খান, সংগঠক ও শিক্ষাবিদ
২৬. তৃষিয়া নাশতারান, নারীবাদী সংগঠক ও ফিউচারিস্ট
২৭. মহিমা চৌধুরী, শিক্ষার্থী ও টিম লিডার, অরোধ্য ফাউন্ডেশন
