জরুরী প্রেস বিজ্ঞপ্তি
২ মে, ২০২৫
বিষয়: নারীদের প্রতি অপমানজনক মন্তব্য – সামাজিক ও আইনগত প্রতিকার প্রয়োজন
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন নারীবান্ধব প্রস্তাব পেশ করবে সেটিই প্রত্যাশা এবং সেটিই উচিৎ। একটি কমিশনে সকল প্রস্তাব সকলের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হবে এমন ভাববার কোন কারণ নেই। যার যার যে সকল প্রস্তাবে আপত্তি আছে সেসব প্রস্তাব নিয়ে তর্ক বিতর্ক বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নের জন্য জরুরীও বটে।
কিন্তু আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি কেবল নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় এলেই একদল যেন দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য় হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে কি তাদের খুব অসুবিধা হবে? তারা কি এই সমাজের বাইরে? যুক্তি তর্কের বালাই না রেখে তারা পুরো কমিশন বাতিল করতে চায়। এই হীন চক্রান্ত কেন? এটি কি আসলেই সরল ধর্মীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ? একদম না। সকল ধর্মই তো সমতার কথা বলে।
আমরা মনে করি এরা নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করে নারীর প্রতি যে আজন্ম ঘৃণা, হিংস্রতা ও নিপীড়নের মনোভাব লালন করে সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের বক্তব্যে নারীদের নোংরাভাবে উপস্থাপন করে তারা নিজেদের ব্যাক্তিগত চিন্তা, চেতনা ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতাও প্রকাশ করছে। এরা নারীর প্রতি এই অসম্মান নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনার স্বপ্নও দেখে!
দেশের ৫১ শতাংশ নারীকে বাদ দিয়ে অথবা পদদলিত করে সরকার গঠনের দিবা স্বপ্ন কতটা অমূলক সেটি বোঝার বোধবুদ্ধি পর্যন্ত তারা হারিয়েছে।
আসলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য যে প্রজ্ঞা, ঔদার্য, সহনশীলতা, জ্ঞান, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা জরুরী এদের সবার মধ্যেই এসব অনুপস্থিত। গলার রগ ফুলিয়ে, চিৎকার করে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া যায়না। সৎ সাহস থাকলে নারী কমিশনের সাথে মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে কোথায়, কেন তাদের আপত্তি সেটি নিয়ে তারা কথা বলতে পারে, প্রমাণ করতে পারে নিজেদের যোগ্য়তা। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ করা কোনো ছেলের হাতের মোয়া নয় যে কেউ অন্যায়ভাবে হুংকার দিবে আর ভয় পেয়ে পুরো কমিশন বাদ দিয়ে দিতে হবে।
নারী কমিশনের প্রত্য়েক সদস্য় দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সাধারণ নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন । দেশের নারী সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় নারীদের অশালীন বাক্যে গালমন্দ করা আমরা কিছুতেই মেনে নেবো না। তাদের বক্তব্য দেশের সংবিধান এবং প্রচলিত আইন কানুনকে নানাভাবে ভঙ্গ করছে। যেমন,
১. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭: সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। এই অনুচ্ছেদ নিশ্চিত করে যে, কোনো নারী যেন বৈষম্যের শিকার না হন, কোনো নাগরিক যেন আইনের ঊর্ধ্বে না থাকেন। হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং মানহানি — এগুলো অপরাধ, এমনকি যদি সেগুলো বিশ্বাসের ভাষায় আচ্ছাদিতও হয়। অনুচ্ছেদ ২৮(২): রাষ্ট্র লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করবে না; এটি জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করে।
২. দণ্ডবিধি ১৫৩ (ক) ধারা: গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বৈরিতা উসকে দেওয়া — পুরুষ বনাম নারী, ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ধর্মীয়।
৩. দণ্ডবিধি ৫০৫(গ) ধারা: এক গোষ্ঠীকে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপরাধ করতে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান।
৪. এরা বিতর্ক নয়, নিপীড়নকে উৎসাহিত করছে। গণতান্ত্রিক বা আইনগত পথে না গিয়ে সরাসরি জনঘৃণা উসকে দিয়েছে।
৫. তারা জনশান্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
৬. দণ্ডবিধি ৫০৫(১)(খ) ধারা: এমন ভয় বা আতঙ্ক সৃষ্টি করা যা জনগণকে অপরাধে উসকে দিতে পারে।
সরকারের কাছে আমরা দাবী করি
১। দণ্ডবিধি ও সংবিধান লঙ্ঘনের সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় ঘৃণা ও হুমকি উসকে দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২। চরমপন্থী হুমকির মুখেও নারীর অধিকার সংশোধন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে—এই মর্মে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনসমক্ষে পুনর্ব্যক্ত করতে হবে।
স্বাক্ষরকারী
১. সৈয়দা রতনা, পরিবেশ আন্দোলনকারি ও সাংস্কৃতিক কর্মী
২. সুলতানা বেগম, গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন সংগঠক
৩. ইশরাত জাহান প্রাচী, মানবাধিকার আইনজীবি ও অধিকারকর্মী
৪. নাজিফা তাসনিম খানম তিশা, থিয়েটারকর্মী
৫. লায়েকা বশীর,শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
৬. ড. নাসরিন সিরাজ, নৃবিজ্ঞানী
৭. ব্য়ারিস্টার তাবাস্সুম মেহেনাজ, মানবাধিকার আইনজীবি ও অধিকারকর্মী
৮. সায়দিয়া গুলরুখ,সাংবাদিক
৯. হানা শামস আহমেদ, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী
১০. নাসরিন খন্দকার, নৃবিজ্ঞানী
১১. জান্নাতুল মাওয়া , আলোকচিত্রী
১২.আদিবা রাইসা,উন্নয়ন কর্মী
১৩. কাব্য কৃত্তিকা, গবেষক ও শিক্ষক
১৪. সৈয়দা নূর-ই-রায়হান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্ট্রাক্টর
১৫.অরুণিমা তাহসিন, গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট
১৬. আমিনা সুলতানা সোনিয়া, অ্যাক্টিভিস্ট ও উন্নয়ন কর্মী
১৭. তারান্নুম নিবিড়, আর্টিস্ট
১৮. উযমা তাজ্বরিয়ান, অধিকার কর্মী
১৯. নুসরাত মেরাজী, ব্যারিস্টার-এট-ল
২০. তৃষিয়া নাশতারান, নারীবাদী সংগঠক ও ফিউচারিস্ট
২১. সামিনা লুৎফা, অধ্য়াপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্য়ালয়
২২. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্য়াপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্য়ালয়।
২৩. ফারজানা ওয়াহিদ, সংগীত শিল্পী
