নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন এবং নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা থেকে আমরা কী পেলাম?

Posted by

·

,

নাফিসা তানজীম

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যা ছিল এবং ছিল না

নারীবাদের একজন মনোযোগী পাঠক হিসেবে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম। একদম প্রথম পৃষ্ঠার “নারী-পুরুষের সমতা অর্জন”-এর ভাষাটা চোখে লাগলো। বলা বাহুল্য, আমি হলাম সেই নারীবাদী যে নারী-পুরুষের সমতা চায় না।

শুধু আমি না। আমার এই পাঠ নেয়া বেল হুক্সের কাছে। বেল হুক্সকে পশ্চিমা, সাদা নারীবাদী বলে ক্যানসেল করে দেয়ার অবকাশ নেই। বরং পশ্চিমা, সাদা নারীবাদের অত্যন্ত গঠনমূলক সমালোচনা আমরা এই ব্ল্যাক ফেমিনিস্টের কাছে পাই। পঁচিশ বছর আগে বেল হুক্স বলে গেছেন নিপীড়নের যে অন্তর্জাল – সেই সিস্টেমকে না ভাঙলে পুরুষের সাথে সমতা অর্জন করে লাভ নাই। কারণ পিতৃতন্ত্র এমন একটা সিস্টেম যেটা একা নারীকে অবদমন করে না। উপনিবেশবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদ নারীকে অবদমন করে। পুঁজিবাদ নারীকে অবদমন করে। বিষমকামতন্ত্র নারীকে অবদমন করে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ নারীকে অবদমন করে। ইন ফ্যাক্ট পিতৃতন্ত্র হলো একই সাথে উপনিবেশবাদী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী, পুঁজিবাদী এবং বিষমকামবাদী। এই উপনিবেশবাদী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী, পুঁজিবাদী, বিষমকামবাদী পিতৃতন্ত্রকে ভাঙতে না পারলে নারীর মুক্তি নেই। শুধু সমতার আশায় বসে থাকলে নারীর পক্ষে হয়তো একজন মার্গারেট থ্যাচার, একজন কামালা হ্যারিস, একজন শেখ হাসিনা হওয়া সম্ভব। কিন্তু একজন শেখ হাসিনা যে নারীর মুক্তি আনতে পারে না, সেটা আমরা খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছি।

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনটি পড়ে মনে হলো আমরা এখনও সেই সমতার ধারণাতেই আটকে আছি। টু বি ফেয়ার, এই প্রতিবেদনে বেশ কিছু কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। যেমন এই প্রতিবেদনে সংবিধানের খুব জরুরি কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সীমিত জায়গায় সরকারের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত না করে কীভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে সেটার রুপরেখা দেয়া হয়েছে। আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকে কীভাবে ঢেলে সাজাতে হবে সেই দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

কিন্তু তারপরও প্রতিবেদনটি পড়তে গিয়ে দেখলাম পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্পকে বলা হয়েছে “সংঘাতশ্লিষ্ট এলাকা” (পৃ. ১২)। এই ভাষা পড়ে পশ্চিমা মিডিয়ার ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন “কনফ্লিক্ট” কাভার করা কথা মনে হলো। বহুদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্যবাদী মিডিয়া ইসরায়েলি সেটলার কলোনিয়ালিজম আর জেনোসাইডকে “ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন কনফ্লিক্ট” বলে বর্ণনা করে আসছে। সেটলার কলোনিয়ালিজমকে “সংঘাত” বললে মনে হয় দুই পক্ষেরই সমান ক্ষমতা বা সমান দোষ আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি সেটলার কলোনিয়ালিজম  নিয়ে এবং রোহিঙ্গা শরনার্থীদেরকে রাষ্ট্র কীভাবে কাঠামোগতভাবে “আদার” বানিয়ে রেখেছে, সেটা নিয়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কাছে একটু শক্ত বিশ্লেষণ আশা করেছিলাম।

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের প্রথম পৃষ্ঠায় যেহেতু পুরুষের সাথে নারীর সমতাকে মুখ্য বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, পুরো প্রতিবেদনে তাই “নারী এবং পুরুষ” – এই বাইনারির বাইরে যে ট্রান্স, কুইয়্যার, নন-বাইনারি মানুষেরা আছেন, তাদের কথা নাই। অবাক হইনি। সরকারি একটা কমিশনের র‍্যাডিক্যাল হওয়ার একটা লিমিট আছে। তারপরও দেখলাম প্রতিবেদনটি সংবিধান সংস্কারের চ্যাপ্টারে “নারী-পুরুষভেদ” ভাষার পরিবর্তে “লিঙ্গ পরিচয়” ব্যবহার করার সুপারিশ করেছে (পৃ। ৩৩)। এর থেকে বোঝা যায় সেক্স/জেন্ডার বাইনারির প্রতি কমিশনের মনোযোগ ছিল। কিন্তু প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উপনিবেশবাদী, পুঁজিবাদী, সিসজেন্ডার-বাঙালি-মুসলিম-পুরুষ-আধিপত্যবাদী, বিষমকামবাদী পুরুষতন্ত্রকে ভেঙে-চুড়ে ফেলার কথাগুলো বেশ পরোক্ষভাবে, আড়ালে-আবডালে রেখে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে “রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াকে” নারীর উন্নয়নের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (পৃ. ২৬)। এখন রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া মানে এই না যে বাংলাদেশের মানুষ হঠাৎ করে কট্টর এবং রক্ষণশীল হয়ে গেছে। একটা লম্বা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলাফল হলো এখন আমরা যা দেখছি। এই প্রক্রিয়ার ইতিহাস এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিটা বোঝা খুব দরকার।

আমাদের বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ সন্তানদের কেন কওমী মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছে? কওমী মাদ্রাসায় পাঠানোর একটা বড় কারণ হলো কওমী মাদ্রাসায় পড়াশোনা-থাকা-খাওয়া ফ্রি প্লাস বোনাস হিসেবে থাকছে পরকালে বেহেশত নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা। শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের থাকা-খাওয়া-পড়াশোনার ব্যবস্থাটা রাষ্ট্র করতে পারছে না কেন? যে মৌলিক চাহিদা পূরণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সেই দায়িত্ব পালন না করে কেন সেটা প্রাইভেট কওমী মাদ্রাসার হাতে ছেড়ে দেয়া হলো? লাগামছাড়া প্রাইভেটাইজেশানের ফলে আমাদের সামাজিক সুরক্ষার বারোটা বাজলো কীভাবে? শুধু গরীব মানুষ রক্ষণশীল হয় না, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষও রক্ষণশীল হয়। তাদের রক্ষণশীল আইডিয়া এবং প্র্যাকটিসগুলো তৈরি হচ্ছে কীভাবে? সৌদি পেট্রোডলার কীভাবে সারা বিশ্বব্যাপী সালাফিজম আর ওয়াহিবিজমকে প্রোমোট করে প্রতিপত্তি বিস্তার করছে? কীভাবে কওমী মাদ্রাসা আর ইনফ্লুয়েন্সার প্রিচাররা সৌদি ফান্ড আর মানুষের ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে যাকাত আর ডোনেশান ব্যবহার করে সৌদি সালাফিজম আর ওয়াহাবিজমকে প্রোমোট করছে? এই প্রোমোশনের লাভের গুড় কে বা কোন কোন প্রতিষ্ঠান খাচ্ছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজলে হেফাযতের মিছিলে এত নারীবিদ্বেষী মানুষ কীভাবে জড়ো হলো, তার উত্তর কখনই পাওয়া যাবে না।

রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া এবং রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া

এখন সমস্যা হলো – আমাদের রক্ষণশীল ডানপন্থীদের কাছ থেকে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের খুব সীমিত কিছু টপিক নিয়ে এত ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া আসলো যে স্বাভাবিকভাবেই নারীবাদী, প্রগতিশীল মানুষজন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে শক্তভাবে সমর্থন করলেন। এই আক্রমণ-প্র্তিরক্ষার খেলায় এই প্রতিবেদনটিকে কীভাবে আরো সমৃদ্ধ করা যেত, সে বিষয়ে কোনধরণের গঠনমূলক আলোচনার আর কোন স্থান থাকলো না।

যারা প্রতিবেদনটি সমর্থন করলেন, তাদের অনেকে যুক্তি দিলেন যে এই প্রতিবেদনটি শুধু কিছু নীতিগত সুপারিশ প্রস্তাব করেছে। এটি কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে না। কেউ বললেন অভিন্ন পারিবারিক আইনের যে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে, সেটা শুধু একটা অপশান। কারো ইচ্ছা হলে সে এই আইন অনুসরণ করবে। আর ইচ্ছা না হলে আগের ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনই অনুসরণ করবে। কিন্তু একই পরিবারের দুইজন যদি দুইরকম ইচ্ছা পোষণ করেন, তাহলে কী হবে সেটা নিয়ে কোন আলোচনা হলো না। কেউ বললেন ক্লাসিক ইসলামিক আইনশাস্ত্রের পট পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখনকার প্রেক্ষিতে প্রাচীন শাস্ত্রের অনেক নিয়ম-কানুনই অন্যায্য। কেউ কেউ অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশের উদাহরণ দেখালেন যারা নারী-পুরুষকে আইনগত সমতা দিয়েছে অথবা দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

কিন্তু যেটা কখনই হলো না – সেটা হলো আক্রমণ অথবা সমর্থনের বাইরে গিয়ে প্রতিবেদনটিকে কীভাবে আরো সমৃদ্ধ করা যেতো অথবা যে বিষয়গুলো বাদ গেছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা এবং সমালোচনা। কীভাবে এই প্রতিবেদনের প্রস্তাবিত ধাপগুলোকে সমৃদ্ধ করে উপনিবেশবাদী, সিস-বাঙালি-বিষমকামী-মুসলিম-পুরুষের আধিপত্যবাদী, পুঁজিবাদী পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা করার কোন অবকাশ থাকলো না।

তাহলে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের অর্জনটা কী?

আমার নিজের আসলে আমলাতান্ত্রিক, আইনি এবং সংস্কারমুখী নারীবাদের ওপরে বিশেষ ভরসা নেই। কারণ এই নারীবাদ একটা বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে থেকে খুব বেশি ঝামেলা তৈরি না করে সংস্কারমুখী কাজ করতে চায়। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনও একটা আমলাতান্ত্রিক ও সংস্কারমুখী উদ্যোগ। তবে বলতেই হবে এটি একটি ভালো উদ্যোগ।

এই কমিশনের প্রতিবেদন বাংলাদেশের নারীদের বর্তমান অবস্থার একটি বিশদ পর্যালোচনা করেছে। প্রতিবেদনটি নারীরা প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়, সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার পথ চিহ্নিত করেছে। এটি শ্রমজীবী নারী, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী নারী, শরণার্থী নারী এবং অন্যান্য প্রান্তিক ও সংখ্যালঘুত্বকৃত পটভূমি থেকে উঠে আসা নারীদের বহুমাত্রিক বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছে।

কিন্ত তারপরও এই প্রতিবেদনটি নেহায়তই একটি সুপারিশ। এর কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। অন্তবর্তীকালীন সরকার এটি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য নয়। তার ওপরে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার জাতীয় নির্বাচন ছাড়াই সংগঠিত হয়েছে। এই সরকার কোন নির্বাচিত পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহি করে না। ফলে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ অন্যান্য সব সংস্কার কমিশনের বেশিরভাগ কাঠামোগত পরিবর্তনের সুপারিশ বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় – এত কষ্ট করে ৩১৮ পৃষ্ঠার ৪৩৩টা সুপারিশ তৈরি করে কী হলো? এই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, “এই প্রতিবেদন জনমানসে নাড়া দেবে, ভাবাবে এবং তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে নারীর সমতা অর্জনে সহায়ক হবে” (পৃ. ৯)।

আমি বলবো এই ভাবনা-চিন্তা এবং তর্ক-বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি করাটাই নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এই প্রতিবেদন অনেক ট্যাবু টপিক – যেগুলো অনেকদিন ধরে আমাদের সমাজে “আলোচনা না করাই ভালো” বলে ধামা-চামা দিয়ে রাখা হয়েছে – সেই টপিকগুলো সামনে তুলে ধরায় আলোচনা-সমালোচনার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর থেকে নারীদের কেন পারিবারিক আইনে সমতা দেয়া উচিত, শুধু পারিবারিক আইন কেন ধর্মীয় আইনের আওতায় পড়ে, কেন যৌনকর্মকে শ্রম আইনের আওতায় আনা উচিত, বৈবাহিক ধর্ষণকে কীভাবে অ্যাড্রেস করা যায়, স্কুলের কারিকুলামে কেন যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত – এই ধরণের অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরণের যুক্তি-তর্ক-মত বিনিময় চলছে। সব যুক্তি-তর্ক সবসময় শান্তিপূর্ণ এবং শ্রদ্ধাশীল না হলেও মানুষ যে এগুলো নিয়ে খোলাখুলি কথা বলছে, সেটা একটা বড় অর্জন। বিতর্ক এবং আলোচনা হলো যেকোন সামাজিক ন্যায়-বিচারের ইস্যুতে জনমত গঠনের প্রথম ধাপ।  

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের অপ্রত্যাশিত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল

আমি জানিনা সংস্কার কমিশনের সদস্যরা তাদের প্রতিবেদনের এই ধরণের প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন কিনা। রক্ষণশীল দিক থেকে আসা প্রতিক্রিয়া তারা আশা করে থাকতেই পারেন। কিন্তু আমি বলবো প্রগতিশীল দিক থেকে সংগঠিত “নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা” সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের কাজের একটা অভূতপূর্ণ – এবং সম্ভবত অপ্রত্যাশিত – একটা ফসল।

নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা শুধু সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে সমর্থন জানানোর মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। ২০২৪ সালের জুলাই বিদ্রোহের পরবর্তী সময় থেকে নারীদের ওপরে ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক সহিংসতা ও জনসমক্ষে হয়রানির ঘটনা এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারের নীরবতা – এসবকিছুর সমালোচনা এবং প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন প্রজন্মের ও বহু স্তরের নারীবাদী ও প্রগতিশীল ব্যক্তি ও সংগঠনকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসে ২০২৫ সালের ১৬ই মেতে সংগঠিত নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা। আমি বলবো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসের একটি অন্যতম বহুমাত্রিক, আন্তঃসংযুক্ত, বিকেন্দ্রীয়, প্রগতিশীল, তৃণমূলভিত্তিক ও স্বতঃর্ফূর্ত নারীবাদী সাংগাঠনিক উদাহরণ হলো নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা ।

নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রার কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম নেই। প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম না থাকার একটা বড় শক্তি হলো একে সহজে টার্গেট করা, প্রভাবিত করা, দখল বা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কোন একক নেতৃত্বে এই আন্দোলন  সংগঠিত হয়নি। তাই কোন একজনকে ভয় দেখিয়ে এই আন্দোলনকে বশে আনার উপায় নেই। এর কোন দেশি-বিদেশি-কর্পোরেট ডোনর ছিল না। যেহেতু ডোনর ছিল না, মৈত্রী যাত্রার কাউকে খুশি করার দায় ছিল না। এই উদ্যোগের তহবিল সংগৃহিত হয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের ক্রাউড-ফান্ডিং মডেলের ভিত্তিতে। সংহতির ভিত্তিতে যার যতটুকু সামর্থ্য, সে ততটুকুই কনট্রিবিউট করেছে। এর ফলে কোন শক্তির কাছে কোনধরণের জবাবদিহিতা না করে মৈত্রী যাত্রা নির্ভয়ে নারীসমাজের দাবীগুলো সামনে আনতে পেরেছে।

বাংলাদেশের নারীবাদী আন্দোলন অনেকদিন থেকেই ৯টা-৫টা পেশাগত দায়িত্ব পালনে রুপ নিয়েছে। কোন দাতা সংস্থার বা কর্পোরেট ফান্ডিং না থাকলে কোন ওয়ার্কশপ, ট্রেনিং, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সমাবেশ – কিচ্ছু হয় না। হাতে-গোণা কিছু তৃণমূল সংগঠন ফান্ডিং ছাড়া ধুঁকে-ধুঁকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে। এই সংগঠনগুলোর বেশিরভাগেরই হয় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তেমন কোন প্রভাব নেই অথবা বড় পর্যায়ে কাজ করার মত সাংগাঠনিক ক্ষমতা বা ফান্ড নেই। উপরন্তু রেজিস্টার্ড এনজিওরা যেহেতু “রাষ্ট্রবিরোধী” কার্যকলাপে যুক্ত থাকার কারণে নিবন্ধন হারানোর ভয়ে থাকে, তারা খুব সাবধানে নিজেদের একটা অরাজনৈতিক চরিত্র বজায় রাখার চেষ্টা করে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই বৃহৎ পর্যায়ে বিপ্লবী নারীবাদী আন্দোলনকে সংগঠিত করাটা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এইসব বাধা সত্ত্বেও খুব অল্প সময়ের নোটিশে নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা খুব সফলভাবে ষাটটিরও বেশি নারীবাদী ও প্রগতিশীল সংগঠন এবং হাজার হাজার মানুষকে পথে নামিয়েছে। মৈত্রী যাত্রায় অংশ নেয়া মানুষের মধ্যে ছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্বকৃত সম্প্রদায়, শ্রমজীবী মানুষ, দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী মানুষ, পোশাক শ্রমিক, চা বাগানের শ্রমিক, গৃহিণী, অবাঙালি জনগোষ্ঠী, যৌনকর্মী, ট্রান্স/কুইয়্যার/নন-বাইনারি মানুষসহ অগণিত প্রান্তিকে থাকা মানুষ।

কীভাবে নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রার ব্যাপ্তি নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে অতিক্রম করেছে

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন একটি সরকারি আমলাতান্ত্রিক উদ্যোগ। সরকারের একটি অস্থায়ী অংশ হিসেবে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনকে অনেক বিষয়েই ভেবে-চিন্তে কথা বলতে হয়েছে। কিন্তু নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা যেহেতু কোন সরকার বা এনজিও বা কর্পোরেশন বা অন্যকোন প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, এই যাত্রায় অনেক অনেক সাহসী ইস্যু এবং বার্তা উঠে এসেছে। যেমন – আগেই বলেছি – নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন আদিবাসী নারীদের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবী জানালেও  আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী যে সহিংসতা চালাচ্ছে, সেটি নিয়ে তেমন কোন মন্তব্য করেনি। কিন্তু নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রায় অনেকে ফিলিস্তিনি কেফিয়াহ পরে এসেন। এই কেফিয়েহ শুধু ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সেটলার কলোনিয়ালিজমের প্রতিবাদ ছিল না। এটি ছিল একই সাথে পাহাড়ে বাঙালি সেটলার কলোনিয়ালিজম এবং সামরিক সহিংসতারও প্রতিবাদ। অংশগ্রহণকারীরা বেসামরিক ও নির্দোষ আদিবাসী বম সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অবসান দাবি করেছেন। তারা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সংগঠক কল্পনা চাকমার অপহরণের বিচার দাবি করেছেন। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ট্রান্স/কুইয়্যার/নন-বাইনারী মানুষদের অধিকারের বিষয়টি সামনে না আনলেও নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রায় অনেক ট্রান্স/কুইয়্যার/নন-বাইনারি মানুষ অংশ নিয়েছেন।  এই যাত্রায় অংশ নিয়ে অত্যন্ত সাহসের সাথে তারা নারীবাদী আন্দোলন এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি দাবী করেছেন।

শুধু মৌলবাদী রক্ষণশীল পুরুষরাই ব্যাটাগিরি করে না, সেকুলার আধুনিক পুরুষরাও ব্যাটাগিরির ধারক ও বাহক

মূলধারার মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আমরা অনেক ছবি এবং ভিডিও দেখেছি যেখানে দাঁড়ি এবং সাদা টুপি, আলখাল্লা পরা মাদ্রাসাশিক্ষিত সিস-বাঙালি-মুসলিম পুরুষেরা নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনকে “ধর্মবিরোধী” আখ্যা দিয়ে সমালোচনা এবং আক্রমণ করছে। এই প্রেক্ষিতে যেকোন সেকুলার, লিবারেল নারীবাদী বিশ্লেষকের পক্ষে মৌলবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার একটা বাইনারি তৈরি করে ফেলা খুব স্বাভাবিক। এই বাইনারি অনুযায়ী মৌলবাদী সাইডে আছে মাদ্রাসাশিক্ষিত প্রগতিবিরোধী রক্ষণশীল মুসলিম পুরুষ যারা ধর্ম ও ঐতিহ্য রক্ষার নামে নারীর ক্ষমতায়নের বিপক্ষে। বাইনারির অন্যদিকে আছে প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ গ্রুপ যারা নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে। এর বাইরে যেন আর কোন কিছু নাই। কিন্তু বাইনারি আলোচনা এই দ্বৈততার কোন কনটেক্স অনুসন্ধান করে না।  আপাত দৃষ্টিতে পরষ্পরবিরোধী গ্রুপগুলো কীভাবে তৈরি হলো তার কোন ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পর্যালোচনা করে না। এই গ্রুপগুলো যে একরৈখিক বা সার্বজনীন নয়, সেই জটিলতার কোন আলাপ করে না। ২০২৫ সালের ৩রা মের হেফাযতে ইসলামের বিশাল সমাবেশের পরে বিভিন্ন মূলধারা এবং সামাজিক মিডিয়ার আলোচনাতে মৌলবাদ বনাম নারীবাদের এই অতি-সরলীকৃত বাইনারির পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাই।

মৌলবাদ বনাম নারীবাদের এই বাইনারি যে বিষয়টি বার বার অগ্রাহ্য করেছে তা হলো ব্যাটাগিরি শুধু মাদ্রাসাশিক্ষিত আলখাল্লা পরা রক্ষণশীল পুরুষই করে না। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের বড় বড় অবস্থানে থাকা অনেক প্যান্ট-শার্ট পরা উচ্চশিক্ষিত তথাকথিত “আধুনিক” পুরুষও ব্যাটাগিরির ধারক ও বাহক। ব্যাটাগিরি জিনিসটা ঠিক কী? ব্যাটাগিরি হলো একধরণের উপনিবেশবাদী, সিস-বিষমকামী-বাঙালি-মুসলিম আধিপত্যবাদী, পুঁজিবাদী এবং নব্য উদারনৈতিকতাপন্থী পুরুষতন্ত্রের একধরণের অবয়বীভূত অভিব্যক্তি। ব্যাটা হওয়ার জন্য পুরুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যে কেউ ব্যাটা হতে পারে। যেমন শেখ হাসিনা ছিলেন ব্যাটাগিরির একজন চরম ও পরম ধারক ও বাহক। ঠিক তেমনি বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা – যিনি আবার হেফাযতে ইসলামীর আমিরও – একমাত্র ব্যাটা না। এই সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকে আসলেও অথবা তথাকথিত “সিভিল সোসাইটির” অংশ হওয়া সত্ত্বেও ভীষণভাবে ব্যাটা। জুলাই আন্দোলনের পরে নারী এবং বিভিন্ন সংখ্যালঘুকৃত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সহিংসতার পরেও অন্তবর্তীকালীন সরকার ব্যাটাগিরি দেখিয়ে ভীষণভাবে নিশ্চুপ ও প্রতিক্রিয়াবিহীন ছিল। সরকারের নিজস্ব একটি শাখা হওয়া সত্ত্বেও তারা নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনকে সমর্থন জানিয়ে একটা বিবৃতিও জারি করেনি।

বরং অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আল-জাজিরাকে দেয়া সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে সরকার একটি “ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার কমিশন” গঠন করবে। এই কমিশন সবগুলো রাজনৈতিক দলের সাথে সমন্বয় করে সংস্কার কমিশনগুলোর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সুপারিশগুলো চিহ্নিত করবে। আমি বলবো যেখানে মোটামুটি সবগুলো সিস-বিষমকামী-মুসলিম-বাঙালি-পুরুষপ্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একটার পর একটা ব্যাটাগিরির উদাহরণ তৈরি করেই যাচ্ছে, সেখানে রাইট-উইং পপুলিজমঘেঁষা এই দলগুলোর জনপ্রিয় ভোটে সবচেয়ে “গ্রহণযোগ্য” সুপারিশ নির্ধারণের চেষ্টা আর যাই হোক – নারীসমাজের জন্য কখনই কল্যাণ বয়ে আনবে না।

নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রার ধর্ম বনাম নারীবাদের বাইনারি অতিক্রম করার আহবান

এই বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যাটাগিরির প্রেক্ষাপটে নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা আমাদেরকে বাংলাদেশের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ সমন্বিত সংগ্রামের ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। মৈত্রী যাত্রার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, পরিবেশবাদী, শিক্ষার্থী, নারী এবং অন্যান্য প্রান্তিক ও সংখ্যালঘুত্বকৃত মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন লড়াই করেছে। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনটি যেখানে নারী-পুরুষের সমতার দাবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা ষ্পষ্টভাবে জানিয়েছে,  “কৃষকের ভূমির অধিকার থেকে শুরু করে পরিবেশগত ন্যায্যতা — প্রতিটিই নারী-সংক্রান্ত বিষয় এবং নারীর অধিকার একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের নির্ণায়ক।“ মৈত্রী যাত্রা অন্তবর্তীকালীন এবং ভবিষ্যত সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী জাতীয় ঐক্যের নামে নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত ও সংখ্যালঘুকৃত জনগোষ্ঠী, হিজড়া ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগণের স্বাধীনতাকে অস্বীকার বা খর্ব করা যাবে না।

নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা শুধু নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়নি। এটি প্রশ্ন তুলেছে – অন্তবর্তীকালীন সরকার কি সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী ব্যাটাগিরির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে? তারা কি একটি লোক দেখানো “গণতন্ত্র” এবং “সংস্কার”-এর নামে একটি অসম সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চায়?

আমি বলবো নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা করেছে, তা হলো ধর্মীয় রক্ষণশীল ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতার মুখেও এটি মৌলবাদ বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা অথবা ইসলাম বনাম নারীবাদের সরলীকৃত দ্বৈততার পুনরোৎপাদন করেনি। বরং মৈত্রী যাত্রা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ব্যাখ্যা করেছে কীভাবে ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। মৈত্রী যাত্রার ঘোষণাপত্র বলেছেঃ “আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময় এবং সংবেদনশীল। সেই বিশালতাকে উপেক্ষা করে আমরা গুটি কয়েক মানুষের সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে সার্বজনীন হতে দেবো না। আমরা অধিকার ও ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে দেবো না, মর্যাদা নিয়ে কোনো ধরনের দ্ব্যর্থকতা মেনে নেবো না।“

প্রাক্তন দাস, দাসপ্রথাবিরোধী ও নারী অধিকার আন্দোলনের সংগঠক সোজার্নার ট্রুথের “Ain’t I a woman?” ভাষণটি যেমন পশ্চিমা, সাদা, মধ্যবিত্তের নারীবাদী আন্দোলনের একটি শক্ত সমালোচনা ছিল, ঠিক তেমনি নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রার ঘোষণাপত্রটিও বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের এনজিওভিত্তিক ফান্ডনির্ভর কুইয়্যার/ট্রান্সফোব নারীবাদের একটি শক্ত সমালোচনা। আমি বলবো “Ain’t I a woman”-এর মতো মৈত্রী যাত্রার ঘোষণাপত্রটিও প্রতিটি নারীবাদী ক্লাসরুমে পড়ানো উচিত। কারণ এই ঘোষণাপত্রটি একটি সত্যিকারের আন্তঃসংযুক্ত, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সিস-বিষমকামী-বাঙালি-মুসলিম আধিপত্যবিরোধী, পিতৃতন্ত্রবিরোধী, পুঁজিবাদী এবং নয়াউদারনৈতিকতাবিরোধী নারীবাদ কেমন হতে পারে, খুব চমৎকার করে তার একটি রুপরেখা নির্মাণ করেছে।

আমাদের পরের পথটি কেমন হবে?

অরুন্ধতী রায় যেমনটা বলেছেন – “মহামারী একটি পোর্টাল” – ঠিক তেমনই আমি বলবো ২০২৪ সালের জুলাই বিদ্রোহ আমাদের সামনে একটা গেটওয়ে তৈরি করেছে। এটা খুলে দিয়েছে একটা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার যে দরজা দিয়ে আমরা নিপীড়নের অতীতকে পেছনে ফেলে একটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, পুঁজিবাদবিরোধী এবং বিষমকামী পিতৃতন্ত্রবিরোধী নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারবো। এখন এই দরজা দিয়ে আমরা কোথায় যাবো এটা আমাদের ওপরেই নির্ভর করছে। আমাদের হাতে অপশান দুটো। আমরা চাইলে আদর্শ নব্যউদারনৈতিক নাগরিক হয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে কোন ধরণের ঝামেলা তৈরি না করে সুবিধাভোগী এবং আরামের একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। অথবা আমরা ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি, ভেঙে-চূড়ে-রক্তাক্ত হয়ে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে পারি এবং একটি সুন্দর, ন্যায্যতা ও সাম্যভিত্তিক সমাজ তৈরির সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারি।

নাফিসা তানজীম একজন শিক্ষক, গবেষক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উস্টার স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অফ ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর ওয়েবসাইট হলো www.ntanjeem.org.

ছবি তুলেছেন সুদেষ্ণা বিশ্বাস