সাদমান আহমেদ সিয়াম
২০২৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থান। সেই গণঅভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট দেশছাড়া হতে বাধ্য হন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ পনের বছরের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নেমে দাঁড়িয়েছিলো দেশের সর্বস্তরের মানুষ – ভেদ ছিলো না কোন জাতিসত্তার, কোন ধর্মের, কোন শ্রেণির। আদিবাসীরা যে যেখানে ছিলেন – সেখানেই নেমেছিলেন প্রতিবাদে মুখর হয়ে। এই পনের বছরে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী আগ্রাসনের প্রকোপে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে নেমে এসেছিলো সেনাবাহিনীর এবং সেটেলার বাঙালিদের খড়্গ, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আয়নাঘরেও যেতে হয়েছিলো মাইকেল চাকমা লোবোর মতো এক্টিভিস্টদের। স্বভাবতই, এই জুলুমের শরিক হিসেবেই নেমে এসেছিলেন আদিবাসী জনগোষ্ঠী, আর ৫ই আগস্টে বিজয়ের পরে সারাদেশে দেয়াল অঙ্কন কর্মসূচির ভিতরে আদিবাসীদের কথাও উঠে আসে নতুন প্রজন্মের রঙতুলিতে। উঠে আসে একটি উক্তি – “Everything that is experimented on the Hills, will be implemented on the plain lands” – যা কিছুই পরীক্ষিত হয় পাহাড়ে, তাই নেমে আসবে সমতলে। আশ্চর্যজনকভাবে, সমতলে এই দেয়ালঅঙ্কনের “অনুমতি” এর প্রয়োজন পড়েনি কোনো, শিশু-কিশোরেরা বিনা বাধায় এই স্লোগান তুলে ধরেছে সবখানে। কিন্তু পাহাড়ে, তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে “অনুমতি” পাওয়া যায়নি এই দেয়াললিখনের – সেখানে বাধা দিয়েছে সেনাবাহিনী। আরো বেশি বাধা দিয়েছে এই উক্তিদাতার নাম লেখা নিয়ে। কিসের এত ভয়? এই উক্তি কার? কেনই বা পাহাড়ে তার নাম উচ্চারণ করাও বারণ?
এই উক্তিদাতার নাম কল্পনা চাকমা। যিনি এখনো হয়ে আছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে উপনিবেশবাদের একজন প্রতীক। হয়ে আছেন প্রতিরোধের প্রতীক। শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে নয়, আবহমানকাল ধরে চলে আসা পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধেও।
এই উপমহাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে পিতৃতন্ত্রের সংযোগ অত্যন্ত স্পষ্ট। অন্যদিকে স্পষ্ট নিজের জীবনধারাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাও – কখনো জাতির রূপে আসে সেই প্রচেষ্টা, কখনো ধর্মের রূপে, কখনোবা একইসঙ্গে। দুইধরনের নিপীড়নেরই শিকার হয়ে আসছেন বাংলাদেশের আদিবাসী নারীরা। একদিকে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্টি করেছে নিজস্ব উপনিবেশ, অন্যদিকে পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসন সেই উপনিবেশের মধ্যে তৈরি করেছে আরো বিভাজন। কল্পনা চাকমাদের মতো অসংখ্য নারী এই দ্বৈত শৃঙ্খলের মধ্যে দিনযাপন করেছেন, করছেন। তাই কল্পনা চাকমাকে বুঝতে গেলে জানতে হবে পাহাড়কে। কল্পনা চাকমাকে বুঝতে গেলে জানতে হবে রাষ্ট্রকে। কল্পনা চাকমাকে বুঝতে গেলে জানতে হবে জাতীয়তাবাদকে।
কল্পনা চাকমার জন্ম ১৯৭৬ সালের পহেলা মে, রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামে। গুণরঞ্জন চাকমা এবং বাঁধুনি চাকমার সবচাইতে ছোট সন্তান তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর নিপীড়নের গর্ভে বড় হওয়া যে কারো পক্ষেই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা কঠিন। পরিস্থিতির প্রয়োজনেই রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠে মানুষ। কল্পনা চাকমাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। একদিকে তিনি যেমন অনুধাবন করছিলেন তার রাষ্ট্র নিপীড়ন চালাচ্ছে তার অস্তিত্বের সঙ্গে লেগে থাকা পাহাড় এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপরে, অন্যদিকে অনুভব করছিলেন পুরুষতন্ত্রের শিকলকেও। নারীদেহ মাত্রই রাজনৈতিক – পুরুষতন্ত্রের উপনিবেশী চোখ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় নারীর দেহকে, তার চলাচল, তার মতামত, তার ক্রিয়াকে।
১৯৯১ সালে তিনি বাঘাইছড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। তারপর থেকেই তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সঙ্গে। হিল উইমেন্স ফেডারেশন ছিলো কল্পনার চোখে থাকা স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটি সংগঠন – যারা আদিবাসী নারীদের উপর চলমান দ্বৈত নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকণ্ঠ।
কল্পনা চাকমা নিজের রাজনৈতিক জীবনে বাধা পাননি – এমনটা নয়। সেই বাধা একদিকে যেমন এসেছে সেনাবাহিনী এবং সেটেলার বাঙালিদের তরফ থেকে, অন্যদিকে এসেছে তার নিজস্ব সমাজ থেকেও। সেই বাধা পদদলিত করেই নিজের মতো এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। প্রচুর পড়ার চেষ্টা করেছেন, প্রচুর জানার চেষ্টা করেছেন। হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক সম্পাদিত “কল্পনা চাকমার ডায়েরি” সেই সংগ্রামের জ্বলজ্যান্ত এক আখ্যান। কি নিয়ে কথা বলতেন না কল্পনা চাকমা? কি নিয়ে ভাবতেন না? ইরাক-ইরান যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা – ছোট্ট সেই ডায়েরির ভেতর খুঁজে পাওয়া যায় এক অসীম ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকা মানুষকে। নিজের নারীমুক্তির সংগ্রামকে একীভূত করতে চেয়েছিলেন বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে। লিখেছেন, “আসলে পাহাড়িদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যতীত পৃথকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের মুক্তি হতে পারে না। কাজেই নারীকে শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে হলে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু নারীমুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়।”
৫ই আগস্টের পর দেয়াললিখনে উঠে আসা স্লোগানেও এই মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় – যা কিছুই পরীক্ষিত হয় পাহাড়ে, তাই নেমে আসবে সমতলে। জুলাই-আগস্টের অবরুদ্ধকালে সেই বক্তব্যের মর্মার্থ সবাই-ই বুঝতে পেরেছিলেন। নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে চলতে না পারার মুহূর্তে সবাই-ই স্মরণ করছিলেন তাকেই – যেন ঠিক তার বলে যাওয়া কথা অনুযায়ীই পাহাড়ের নিপীড়ন নেমে এসেছে সমতলে। দূরদর্শী এই রাজনীতির মূল কথা এই যে – Nobody Is Free Until Everyone Is Free. এই কথাকে ধারণ করেই কল্পনা চাকমার রাজনীতি ছিলো বৃহৎ । পুরুষতন্ত্রের হাত থেকে নারীমুক্তি, বাঙালি জাতীয়তাবাদী উপনিবেশ থেকে জুম্ম জনগণের মুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে নাগরিকের মুক্তি – এরা বিচ্ছিন্ন কোন আন্দোলন নয়, বরং একইসূত্রে গাঁথা।
কিন্তু কিভাবে এই সংগ্রামী নারীকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হলো, তা এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি।
১৯৯৬ সালের ১২ই জুন। হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের তারিখ। নির্বাচনের মাত্র সাত ঘণ্টা আগে অপহৃত হন কল্পনা চাকমা।
কল্পনার ভাই কালিন্দি কুমার চাকমা এবং লালবিহারী চাকমার ভাষ্য অনুযায়ী, ১২ই জুন দিবাগত রাত্রে অপহরণকারীরা দরজার রশি কেটে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তাদের তিনজনকে চোখ বেঁধে বাইরে নিয়ে আসা হয়। ঘটনাচক্রে অপহরণকারীদের আক্রমণ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন দুই ভাই। কিন্তু কল্পনা চাকমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার পরিক্রমা পাঠ করলেই স্পষ্ট যে, এই অপহরণের উদ্দেশ্য কল্পনা চাকমাই। আর কেউ নন। কালিন্দি কুমার চাকমা এবং লালবিহারী চাকমা লেফট্যানেন্ট ফেরদৌস কায়ছার খান, ভিডিপি(গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী) এর সদস্য নুরুল হক এবং সালেহ আহমেদের নাম উল্লেখ করেন এই অপহরণের মূল নেতৃত্ব হিসেবে।
কিন্তু এই তদন্ত নিয়েও হয় অনেক রকমের গড়িমসি, এবং প্রহসন। রটানো হয় বিভিন্ন ধরনের গল্প। পরবর্তীতে দেশে-বিদেশে মানবাধিকার সংস্থাগুলির চাপে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু সেই তদন্ত প্রতিবেদন নিজেও আরেক হতাশাব্যঞ্জক অধ্যায়। বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দাদের রিপোর্টে উঠে আসেনি প্রকৃত দোষীদের নাম। হদিস পাওয়া যায়নি কল্পনা চাকমারও। রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে তার নাগরিকের সন্ধান দিতে। ৫ই আগস্টের আয়নাঘর উন্মোচনের পর মাইকেল চাকমা ফিরে আসার ঘটনায় ধারণা করা হয়েছিলো যদি কল্পনা চাকমাও কোনভাবে আয়নাঘরে আছেন কি না। কিন্তু সে আশাও সুদূর পরাহত বলে ধারণা করা হয়।
কল্পনা চাকমা আছেন কি নেই – তা অনিশ্চিত। যদিও থেকে থাকেন, তবে কোথায় আছেন – তাও অনিশ্চিত। কিন্তু কল্পনা চাকমা যে আজও পাহাড়ে জ্বলন্ত প্রতিরোধের নাম – এই প্রতিরোধই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আজও পাহাড়ে সেনাবাহিনী তার নামে দেয়াললিখন করতে দেয় না। এখানেই কল্পনা চাকমার জয়।
কল্পনা চাকমা হয়ে থাকবেন সকল নিপীড়িত মানুষের প্রতীক হিসাবে – সেই নিপীড়ন জাতির ভিত্তিতে হোক আর লিঙ্গের ভিত্তিতে। আর আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবেন তার অনন্ত প্রতিরোধের গান – সকলের মুক্তিতেই প্রকৃত মুক্তি।
