কল্পনা চাকমার আর কোনো পেলে কী খবর?

Posted by

·

,

ইসমাম জামান

চিন্তা করুন – আপনি আপনার পরিবারের সাথে নিজ বাড়িতে ঘুমাচ্ছেন। গভীর রাতে অতর্কিতে একদল লোক চোখমুখ ঢেকে সাদা পোশাকে এসে আপনাকে তুলে নিয়ে গেল আপনার মা, আপনার ভাইদের চোখের সামনে থেকে। সেই থেকে একদিন, দুদিন করে আজ ২৯টা বছর। আপনার পরিবার জানেও না আপনি বেঁচে আছেন নাকি আপনাকে মেরে ফেলা হয়েছে। যদি আপনাকে মেরে ফেলাই হয়, কী দোষে মরলেন আপনি।

কি বীভৎস শোনাচ্ছে, তাই না? আমি আমার প্রচন্ডতম শত্রুকেও এমন পরিণতির অভিশাপ হয়তো দিব না। কিন্তু এমনটাই ঘটেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নারীবাদী নেত্রী কল্পনা চাকমার সাথে।

সময়টা ১২ জুন,১৯৯৬। দেশে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মাঝ রাতে নিজ পরিবারের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় কল্পনা চাকমা ও তার দুই ভাইকে। তার দুই ভাই সে রাতে বুলেটের সামনে থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় পালিয়ে বেঁচে ফিরতে পেরেছিল। ফিরে আসতে দেওয়া হয়নি কল্পনা চাকমাকে। পলায়নরত কল্পনা চাকমার ভাই শুনতে পেয়েছিল বোনের অকুণ্ঠ আর্তনাদ ও বাঁচার আকুতি। হয়তো আজ ২৯ বছর পরও ঘুমের মাঝে কল্পনার সেই মুক্তির ক্রন্দন তাদের তাড়া করে বেড়ায়।

কে অপহরণ করলো কল্পনাকে?

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভাব হওয়ার পর থেকে কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে সমতলের বাঙালিদের সহাবস্থানের যাত্রাটা খুব মসৃণ ছিল না। ’৭২ সালে শেখ মুজিবের উপজাতিদের(তৎকালীন) উদ্দেশ্যে বলা “তোমরা সবাই বাঙালি হয়ে যাও” কিংবা জিয়াউর রহমানের পার্বত্য অঞ্চলে অবৈধ সেটেলার প্রবেশ করিয়ে সেখানকার ডেমোগ্রাফি পরিবর্তন করে ফেলতে চাওয়া বাঙালি শাসকদের অপচেষ্টাকে পার্বত্য অঞ্চল থেকে প্রতিরোধের দ্বারাই মোকাবেলা করা হয়েছে। সেই প্রতিরোধকারীদের একজন, নিজের মাটি ও নাড়ির প্রশ্নে অনড় থাকা এক কন্ঠস্বর ছিলেন কল্পনা চাকমা। সে পাহাড় ও সমতলের মানুষের সমতার কথা বলতো। সে পাহাড়ের মানুষের মুক্তির কথা বলতো। সে নারী মুক্তি,নারীবাদ নিয়ে আপোষহীনভাবে লড়ে যাচ্ছিল মাত্র ২২ বছর বয়সেই।
কল্পনা চাকমা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতো। ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতো ক্ষমতার আড়ালে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শোষণ করার সমস্ত অপবাসনাকে। ক্ষমতার ঠিকাদারদের তাই খুব জরুরি ছিল এই কণ্ঠস্বরকে চুপ করিয়ে দেওয়ার। লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস নামে এক মেজরের সাথে কল্পনার বিবাদ চলছিল বেশ ক’দিন ধরেই। তারই জের ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কল্পনা চাকমাকে রাতের অন্ধকারে অপহরণ করে নিয়ে যায় লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস। আজ ২৯ বছর পরও আমরা তার হদিস খুঁজে ফিরছি।

সে রাতে অপহরণের পর তার পরিবার ছাড়াও এলাকাবাসী সকলেই নিশ্চিত করেছিল কল্পনাকে তুলে নিয়ে যায় সেই মেজর। পরদিন পুলিশের কাছে এ নিয়ে জবাবদিহি চাইতে গেলে তারা তো এ বিষয়ে মুখ খুলেই না-বরং মামলা টুকুও নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

২২ বছর বয়সী কল্পনা যেভাবে হয়ে উঠলো রেজিস্ট্যান্সের প্রতীক

কল্পনা চাকমা হারিয়ে যাওয়ার পর তার ঘর থেকে একটি ডাইরি উদ্ধার করা হয়,যার প্রথম লাইনে জ্বলজ্বল করছিল, “জীবন মানেই তো সংগ্রাম।” আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র সুদীর্ঘ ২৯ বছরেও কল্পনা চাকমার সন্ধান দিতে পারেনি।অপহরণকারী লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসকে আজও পর্যন্ত এই প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে নাই-কল্পনা চাকমা কোথায়।

তাই বলে কল্পনা চাকমাকে মুছে ফেলা যায়নি।পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের পথ ধরে আজও যখন কোনো শোষণের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা সোচ্চার হয়,তাদের ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে ওঠে কল্পনা চাকমা।জানান দেয় তাঁর সংগ্রামী উপস্থিতি।

ক্ষমতা আজও কল্পনাদেরকে প্রচণ্ড ভয় করে। কিন্তু ক্ষমতা বুঝে উঠতে পারে না-এভাবে কল্পনাদেরকে দমানো যায় না। কল্পনা চাকমা যে মুক্তির সুর,মুক্তির যেই সংক্রামক নেশায় নিজের ২২ বছর বয়সী জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন,তা আজ পাহাড় ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে সমতলেও। সম্প্রতি ২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানে কল্পনা চাকমার উক্তি ও স্বয়ং তাঁর বারংবার আলোচনায় উঠে আসা প্রমাণ করে কল্পনা চাকমা হারিয়ে যায়নি। কল্পনা চাকমারা হারিয়ে যায় না। তারা ফিরে আসে। যুগ থেকে যুগে। ক্ষমতাকে প্রশ্নের তীরে বিদ্ধ করতে। শোষকের হাতকে দুমড়ে মুচড়ে “সমতল থেকে পাহাড়,এবার মুক্তি সবার” এর মতো কথাকে এস্টাব্লিশ করার লক্ষ্যে। পাহাড় ও সমতলের প্রতিটি মুক্তিকামী জনতাই যেন হয়ে ওঠে একেকজন কল্পনা চাকমা।