রিফাত মাহবুব
কিছু বিপদ দূর থেকেই আঁচ করা যায়। কিংবা, হয়তো কিছু মানুষ বিপদের কথা মুখে আনলেই বিপদরা হুড়মুড় করে চলে আসে। দেশ আর বিদেশের মধ্যে আজকাল পার্থক্য নাই—সবাই-ডিজিটাল দুনিয়ায় যুক্ত । একেবারেই কি নাই ? আছে, পার্থক্য আছে। ২০২৩ সালে দেশে যেয়ে মন খারাপ হয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো চারিদিকে গুমোট ভয় কিন্তু সবাই “আমি তো ভাই সাধারণ মানুষ, আমি কি করবো” ধরণের ভাব। যাইহোক, দেশে থাকি না, তাই দেশ নিয়ে আলাপ বাতুলতা। ১৫ দিন কাটিয়ে ফিরে এসে ভাবলাম, ‘২৪ এ আর দেশে যাবো না। এতো টাকা খরচ করে এই গুমোট দেশে যে কি হবে ? আত্মা যেখানে নেই, আত্মীয় আর কোথায় থাকবে ?
‘২৪ এর জানুয়ারির নির্বাচনে অবাক হলাম না। “আমি ভাই সাধারণ মানুষ, রাজনীতির চিন্তা আমি করি না’, এমন দেশে ডামি নির্বাচন হবে, ক্ষমতার ক্ষমতায়ন হবে তা আর অবাক হওয়ার কি ? কিন্তু ঐযে, বিপদের গন্ধ আগেই পাওয়ার অভ্যাস আছে। তাই ভাবলাম, শেলির ‘ওজিমান্ডিয়াস’ কবিতা – ‘কিং অফ কিংসও’ ধূলিসাৎ হয়েছিলো,পর্বতের চূড়া থেকেই নিচে পরতে হয়। জানুয়ারির পর থেকেই আরশ কাঁপা কাঁপাই মনে হচ্ছিলো । বেনজির দুর্নীতি, এমপি আনার হত্যা, ছাগল কাণ্ড – দেশ এক রঙ্গমঞ্চ, আর তারই মাঝে চলে উৎসব, অনুষ্ঠান, বিরাজনীতির আনন্দ-যজ্ঞ। দূর থেকে দেখি আর ভাবি, “হয়ত আমারই ভুল, সব ঠিকই আছে, নাহলে সবাই কিভাবে দিব্বি চলছে, ফিরছে ?” এভাবেই জুলাই আসলো, দেশে কোটা আন্দোলন দানা বাঁধে । তাও দেখি সোশ্যাল মিডিয়ার জগৎ সাদা-মাটা, সবাই যে-যার কাজ করছে। কিছুটা বিরক্ত হয়েই একদিন ফেইসবুকে লিখলাম, কোটা আন্দোলনকে যদি কেউ শুধু চাকরির আন্দোলন ভাবেন তাহলে ভুল করবেন। রাষ্ট্রের প্রতি যখন বিশ্বাস হারিয়ে যায় তখন নাগরিকদের পথে নামতে হয়। কিছু লাইক পরলো বটে।
১৫ই জুলাই সকাল থেকেই মনটা উচাটন, অফিস শুরু করলেও চোখটা পরে থাকে দেশের অনলাইন পত্রিকায়। দুই-একজন বন্ধুকে লিখলামও, দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না, কি যে হয় ! তারা বললো, “এমন আগেও হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।” মেনে নিলাম।
১৬ই জুলাই। অফিস করছি আর পত্রিকায় চোখ রাখছি। হঠাৎ রংপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্র নিহত হওয়ার হেডলাইন পড়লাম। বারবার পড়লাম, চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। আবু সাঈদ। কিছুই জানিনা তখন, কিন্তু মানস-কল্পনায় চিত্র ফুটে উঠলো — এক অতি-আবেগী, হিসাব না করা তাজা জীবন, যে বিনা চিন্তায় গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে। হলফ করে বলতে পারি, বিশ্বের ‘উন্নত’ দেশে এমন ‘বোকা’ মানুষ খুব বেশি পাওয়া যায় যাবে না। ঝাপসা চোখেই ফেইসবুকে লিখেছিলাম, আবু সাঈদের মা’কে চিনি না। ওঁর বোকা ছেলে কেনো যেনো সবার আগে মৃত্যুকে বুকে তুলে নিলো। পরে জেনেছিলাম, আবু সাঈদ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। গর্ব হয়েছিলো, সাহিত্যে পড়া ছেলে-মেয়েরাই তো যুগে যুগে আগুনে ঝাঁপ দেয়। নিজে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে অন্যকে মুক্তি দেয়। সমাজের জন্যই সাহিত্যের দরকার।
এরপরের দিনগুলো তো রক্তের রঙে লাল।
দিন যায়, রাত আসে, অফিস থাকে, মিটিং থাকে, কাজ থাকে—ঘরে, বাইরে, কিন্তু জীবনানন্দের ভাষায় “মাথার ভিতরে কোন এক বোধ কাজ করে।” দেশ থেকে, ফেইসবুক থেকে, বিবিসি বাংলা থেকে চোখ তো সরে না। নির্ঘুম রাতে শুধু স্ক্রল করি। জুলাই ১৮ থেকে দেশ বিশ্ব ছাড়া হয়ে গেলো। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেশে কি সবাইকে মেরে ফেলছে ? লাশের মিছিল নিয়ে বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে বিভিন্ন খবর। নিজের ইন্টারন্যাশনাল সংযোগের মোবাইল ফোনটাই তখন সবার সম্পদ। হাজারবার চেষ্টা করলে দুই একটা মোবাইল ফোনে তিরিশ সেকেন্ডের জন্য সংযোগ পাওয়া যেতো। শব্দ আসতো কড়কড় করে, ভেঙে-ভেঙে । শুধু শুনতে চাইতাম, তোমরা কেমন আছো ? কোনোদিন শুনতে পেতাম, কোনোদিন পেতাম না। বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের এভাবে জিম্মি করতে পারে ! ক্ষমতার মাত্রা দেখে শঙ্কিত হতাম, কিন্তু তার সাথে এও ভাবতাম পতন এবার আর ঠেকানো যাবে না। দেশ কেনো ? বিশ্বের ইতিহাসে হাজারো উদাহরণ আছে এইরকম স্বৈরাচারের পতনের। দূর থেকে ফেইসবুক এক্টিভিজম দিয়েই ‘নিজের আওয়াজ’ তুলতে থাকলাম। তিনজন মানুষের ছোট্ট বাসায় দেশ এমনভাবে গেড়ে বসলো যে ১৪ বছরের মেয়ে বলেই বসলো, “আমরা কি দেশে যাবো? দেশে গেলে কি ওরা মারবে? আমরা কি যুদ্ধ করবো ?”
প্রতিদিনই ভাবি আজ-ই বোধ হয় শুনবো “আর্মির হাতে ক্ষমতা দিয়ে তিনি চলে গেলেন”—আর্মির ক্ষমতা চাইতাম না, কিন্তু এও জানতাম না যে আর কি পথ দেশে খোলা আছে। দেশ যখন বিচ্ছিন্ন তখন প্রবাসীরা নানাভাবে এই বিপ্লব চালিয়ে নিয়ে গেছে, অন্তত দূর থেকে আমরা এক সমষ্টিক ডিজিটাল শক্তি হিসাবেই হাজির ছিলাম। কেউ কাউকে চিনিনা, কোনোদিন দেখা হবে না, কোনোদিন আর আলাপ হবে কিনা সন্দেহ কিন্তু আমরা লিখছি, শেয়ার দিচ্ছি, গুজব আর খবরের দোলনাতে দিন কাটাচ্ছিলাম। জুলাই ২১ বিশেষভাবে মনে আছে—প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের চিঠি বিশ্বের নেতাদের এবং জাতিসংঘের কাছে—বুকে বিশ্বাস আনলাম আমাদের চিৎকার বিশ্বে এবার পৌঁছাবে ।
জুলাই ২৪ থেকে দেশে ইন্টারনেট একটু একটু ফিরতে থাকলো। কিন্তু মিথ্যাচার, অভিনয়, ‘স্বাভাবিক’ সাজার নাটক, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকদের নির্লজ্জতা দেখে মনে হচ্ছিলো কিভাবে সম্ভব ! এই দেশকে ইজারা দেয়া হয়ে গেছে এক ব্যক্তির কাছে ? চারিদিকে ভয়—ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, ফেইসবুকে সেলফ-সেন্সরশিপ দেখে কখনো কখনো একটু রাগও হচ্ছিলো। এতো ভয় ? এতো ভয় হলে ‘৭১ কীভাবে হয়েছিলো ? পরিবারের অনেকে আমাকে বলতে লাগলো, “এবার থেমে যাও নাহলে তোমারও বিপদ হবে।” কিন্তু অনেকে আবার মেসেজ করতো দেশ থেকেই, বলতো, “আমরা লিখতে পারি না, তোমরা চালিয়ে যাও”—সেই দিনগুলো লিখার ভাষা আমার নাই। বিদেশে সবখানে নিজেদের ‘স্বাভাবিক’ দেখাতে হয়, কিন্তু ভিতরে আমরা সবাই এক আগ্নেয়গিরির উৎখরিত উত্তপ্ত লাভা ছিলাম । তবে এড়িয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না—বহু জ্ঞানী, গুণীদের দেখলাম ‘নীরবতাকেই’ ব্রত করে চলছেন। অবাকই হলাম—এমন নির্লিপ্তও হওয়া যায়?
জুলাই ২৯ কে ভুলতে পারবে ? ফেইসবুক লাল, লক্ষ লক্ষ লাল প্রোফাইল। আমি শুধু লাল-প্রোফাইলই করলাম না, নিজের জন্য লিখে ফেললাম নিচের কবিতা, যা দিয়েছিলাম প্রোফাইলে:
সংযত হতে বলো না আমায়
তীব্র ভুলভাবে ভালোবাসার জন্য
কিংবা সত্য কথার অনধিকার চর্চার জন্য।
সংযত হতে বলো না আমায়
সবার আগে মৃত্যুকে বুকে জড়িয়ে নেয়ার জন্য।
সংযত হতে বলো
সেই বুলেটকে যার গতি ঈশ্বর মানে না
সংযত হতে বলো
সেই নীরবতাকে যা পাথরকেও কাঁদায়
সংযত হতে বলো
সেই শক্তিকে যার মূল্য
দিতে হয় রক্তে।
১ অগাস্ট। প্রফেসর সলিমুল্লাহ খানের সাত মিনিটের বক্তব্যের মূল ছিল: “এই সরকারের আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নাই।” এখনো বিশ্বাস করি এই সাত মিনিটের জন্যই তিনি দেশের একজন স্মরণীয় জন-বুদ্ধিজীবী হয়ে থাকবেন। ক্ষমতার আস্ফালনের সামনে যে সত্য কথা বলতে পারেন না তাকে আর যাই হোক আমি বুদ্ধিজীবী মানতে রাজি না। শ্রদ্ধা বাড়লো ওঁর প্রতি, এবং দেখলাম আন্দোলন আবার গতি পাচ্ছে। এরই মাঝে বুঝলাম ফেইসবুকে অনেক ‘বন্ধু’ হারাচ্ছি, বুঝলাম ‘স্বৈরাচার’ দমনে আমি দূর থেকে জাতিকে যতটা ঐক্যবদ্ধ ভেবেছিলাম, দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা ততটা ঐক্যবদ্ধ না। এর প্রকাশ অগাস্ট ৫ এর পর থেকেই প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে।
অগাস্ট ২,৩ দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না। আগে থেকেই গ্রীষ্মের ছুটিতে হাঙ্গেরি যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে গিয়েও চোখ সারাদিন ফোনে—বুদাপেস্টের ইতিহাস, ঐতিহ্যের দিকে চোখ নাই। মৃত্যুর মিছিল চলছেই। অগাস্ট ৬ এর ঢাকামুখী অসহযোগ আন্দোলন যখন ৫ তারিখে এগিয়ে আনা হলো সেই থেকে হোটেলের রুমে ঠায় বসা, কি হবে, কি করবো ? কিছুই ভালো লাগে না, গভীর রাতে (দেশে তখন ৫ তারিখ ভোর) ফেইসবুক পোস্ট দিলাম, বুকে শক্তি রাখেন, বিজয় আসবেই। অগাস্ট ৫ এ সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন আমি হাঙ্গেরির সোপরন নামের ছোট্ট এক শহরের স্টেশনে। গন্তব্য বুদাপেস্ট, সেখান থেকে লন্ডন, বাড়ির পথে। পতনের খবর আগের থেকেই পাচ্ছিলাম, তবু অফিসিয়াল ঘোষণা না হলে তো আর কিছু বলা যায় না। সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনছি আর আমার দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে । আমার কান্না দেখে মেয়ে বলছিলো, “দেশের বিপদ কি শেষ?” শেষ নাকি শুরু জানতাম না, শুধু তখন জানতাম, জনতার বিজয় হয়েছে—হায়রে দেশ—যুগে যুগে কত রক্তের বন্যা বয়ে যায় এই মাটির উপর দিয়ে। ‘৭১ থেকে ‘২৪, এর নামই বাংলাদেশ।
রিফাত মাহবুব, পিএইচডি, লন্ডনে থাকেন।
