লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া
ছোটবেলা থেকে আমি একটা প্রশ্নের সম্মুখীন অনেক হয়েছি, এখনও হচ্ছি: তুমি আগে মুসলিম নাকি আগে বাঙালি? বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ আসার প্রাক্কালে এই ধরনের প্রশ্নগুলোর বাজারদর বেড়ে যায়। বাঙালিত্ব নাকি ইসলামিয়্যাৎ, কোনটিকে এগিয়ে রাখা উচিত এমন দ্বিধায় রীতিমতো ঘাম ঝরে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়। এবং সত্যি বলতে অনেককেই এই দ্বিধায় পড়তেও দেখেছি। আমার কাছে এই ধরনের প্রশ্ন খুবই অযাচিত মনে হতো এবং এখনও হয়।
জীবিকার তাগিদে আমি উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়ণরত অবস্থা থেকেই টিউশন করাতাম। এরপর অনার্সে পড়াকালীন সময় থেকে এখন অব্দি করিয়েই যাচ্ছি। এমন আমার মতো শিক্ষা জীবনে টিউশন করিয়ে অর্থ উপার্জন করে, অর্থাৎ গৃহশিক্ষক আপনি আপনার চারপাশেই দেখতে পাবেন অনেক। এই উদাহরণটি টেনে আনার উদ্দেশ্য হলো, এই বিষয়টি খুবই সম্মুখ একটি উদাহরণ। এখন আমার কথা হলো, এই ব্যক্তিকে একাধারে ছাত্র ও শিক্ষক পরিচয় প্রদানে আমরা কোন বাধা দেই কি? আমার মতো এমন গৃহশিক্ষকরা একাধারে যেমন ছাত্র, আরেকদিকে একজন শিক্ষক। ছাত্র হলে তার শিক্ষক পরিচয় থাকতে পারবে না এমন কোন কথা নেই, বরং এমন কথা আমি তুললে হয়তো আমাকেই সবাই পাগল বলবে। এবং লক্ষনীয় বিষয় এটা যে, তার এই দ্বৈত পরিচয়ে শিক্ষকতা ও ছাত্রত্ব কোনটিই কোনটি দ্বারা বিরূপ প্রভাবান্বিত হচ্ছে না। ঠিক সেই ভাবেই আমরা আগে বা পরে না, একাধারে বাঙালি এবং মুসলিম অথবা আরো অনেক পরিচয়ে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারি। বাঙালি হলে মুসলিম অথবা মুসলিম হলে বাঙালি হওয়া যাবে না এমন কোন কথা নেই। মানুষ তো ভাই একজনই!
একই ব্যক্তি একই সাথে তার অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারে, এটাকে আমরা ইন্টারসেকশনালিটি বলতে পারি। আমরা আমাদের অজান্তেই অনেক ইন্টারসেকশনালিটি মেনে নেই। যেমন একজন শিক্ষক আবার ব্যবসায়ীও হতে পারেন, কোন ইমাম সাহেব চাইলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হতেই পারেন। এখানে আমরা তেমন কোন সমস্যা দেখতে পাইনা। বরং আমি যদি যেয়ে বলি, “ভাই, আপনি তো শিক্ষক মানুষ, আপনি আবার ব্যবসা কেন করবেন, আপনি ভাই ক্লাসেই পড়ান” ,তাহলে হয়তো কোন মারমুখী পরিস্থিতিতেও পরতে পারি, হয়তো মাথা খারাপ আখ্যাও পেতে পারি। কিন্তু এই সহজ ও সরল জিনিসটাই কঠিন ও জটিল হয়ে যায় যখন বিষয়টি নির্দিষ্ট একটি লিঙ্গ থেকে বের হয়ে অন্য লিঙ্গের মানুষদের বিষয় হয়।
একজন শিক্ষক, ব্যবসায়ী পুরুষই হয়তো কোন মহিলাকে বলে ওঠেন, আরে তুমি তো মহিলা, তুমি আবার এ কাজ করবে কেন? অথবা হয়তো কোন চিকিৎসক পিতা(যে একাধারে চিকিৎসক আবার ডাক্তার) তার ছেলেকে বলে ফেলেন, আরে তুই তো ছেলে, তুই মেয়েদের মতো সাজিশ কেনো, মেয়েদের মতো নাচিশ কেনো? একজন মানুষের একাধারে একাধিক পরিচয় থাকতে পারে, এবং কোন পরিচয়গুলোতে সে সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে সেটি একদম ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়। ইমাম সাহেবকে ব্যবসায়ী পরিচয় গ্রহণ করতে না দেয়া যেমন অন্যায়, একজন ছেলেকে নৃত্য শিল্পী হিসেবে পরিচয় গ্রহণ না করতে দেয়াও তেমনই অন্যায়। তেমনিভাবে “লিঙ্গবৈচিত্র্য মানুষ কিন্তু নামাজ পড়ে কেন” এমন প্রশ্নও অবান্তর।
আমরা চাই বা না চাই, এই পৃথিবী পুরোটাই বৈচিত্র্যে ভরা। এবং আমরা সবাই কোন না কোনভাবে একজন অন্যদের থেকে বিচিত্র। বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে শান্তিমতো বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপায় হলো এই বৈচিত্র্যকে মেনে নেয়া। নতুন পৃথিবী হোক একতার পৃথিবী।
—————————————————————————————————
বিঃদ্রঃ এই লেখা বাংলাদেশ ফেমিনিস্ট আর্কাইভস–এর সাপ্তাহিক সিরিজ “পলিটিক্যাল অ্যান্ড পার্সোনাল: বাংলাদেশে লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক ইস্যুগুলোর সংকলন”–এর একটি অংশ। সব প্রকাশিত লেখা পড়তে এবং নতুন লেখা জমা দেওয়ার নির্দেশিকা দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
